অ্যালেক্সাই নাভালনি : পুতিনের আতংক

161
অ্যালেক্সাই নাভালনি : পুতিনের আতংক

অ্যালেক্সাই নাভালনি প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করে ৯ জুন মস্কো সিটি কোর্টের দেয়া রায় তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে। নাভালনির প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ফাইটিং করাপশন (এফবিকে) এবং দেশজুড়ে এ সংগঠনের সব আঞ্চলিক অফিসগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সরকারি কোনো পদ পদবীর জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রাশিয়ার কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন না। নাভালনিকেও উগ্রপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কে এই অ্যালেক্সাই নাভালনি

অ্যালেক্সি নাভালনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর  সমালোচক। বিষ থেকে বেঁচে যাওয়া এক রাজনীতিবিদ। রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা। দীর্ঘদিন যাবৎ রাশিয়াতে সংস্কারের জন্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তিনি।

আরও দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে ভ্লাদিমির পুতিনের আনা সাংবিধানিক সংস্কারের ভোটকে তিনি “ক্যু” বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ওই সংস্কার “সংবিধানের লঙ্ঘন”। নাভালনি ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থাকে “রাশিয়ার রক্তকে চুষে খাওয়ার” সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

অ্যালেক্সাই নাভালনিকে এত ভয় কেন পুতিনের?

বয়সে নাভালনি অনেক ছোট হলেও তিনি পুতিনের জন্য বড় রাজনৈতিক হুমকি। নাভালনি হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতিবিদ নন। তিনি তরুণ বয়স থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। করেছেন যুব আন্দোলন।

নাভালনি এক দশকের বেশি সময় ধরে রাশিয়ায় তাঁর রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত গড়েছেন। তাঁর এই রাজনৈতিক ভিত তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী প্রচারাভিযানের মাধ্যমে তিনি এই ভিত গড়তে সক্ষম হয়েছেন।

নাভালনি একজন আইনজীবী। পেশাগত এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন। ২০০৭ সালে দুর্নীতিবিরোধী প্রচার শুরু করেন নাভালনি। শুধু তা-ই নয়, তিনি দুর্নীতির মুখোশও উন্মোচন করেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি রাশিয়ার মধ্যবিত্ত ও তরুণদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নাভালনি ব্লগ লিখতে শুরু করেন। তাঁর ব্লগ সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে। একই সঙ্গে অস্বস্তি তৈরি করে ক্ষমতার কেন্দ্রে। ২০০৮ সাল থেকে রাশিয়ার রাজনীতিতে একটি শক্তি হিসেবে নাভালনি উত্থান। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর লাখো অনুসারী আছে। তারা প্রধানত তরুণ। এই অনুসারীরা তাঁর শক্তির অন্যতম উৎস।

পুতিন-নাভালনির মধ্যে কে শক্তিশালী?

পুতিন সবচেয়ে বেশি ভয় পান যে ব্যক্তিকে, তিনি হলেন অ্যালেক্সি নাভালনি। কারাবন্দী নাভালনি আরও বেশি শক্তিশালী। তার ডাকে, তার মুক্তির দাবিতে হাজারো মানুষ রাশিয়ার রাজপথে নেমে আসে। রাজধানী মস্কোসহ দেশটির অন্তত ১০০টি শহর-নগরে বিক্ষোভে শামিল হয় হাজারো মানুষ।

পুতিনবিরোধী এত বড় বিক্ষোভ কর্মসূচি আগে দেখেনি রাশিয়ানরা। বিক্ষোভ দমাতে বেপরোয়া কৌশল নেয় ক্রেমলিন। চলে বেধড়ক মারধর। গণহারে ধরপাকড়। পুতিন অনেক আগে থেকেই জানেন, নাভালনি তার গলার কাঁটা। তাই নাভালনিকে দমন করতে মামলা-জেল-জুলুম কোনোটাই বাদ রাখেননি তিনি। এমনকি ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তাকে লড়তে দেওয়া হয়নি।

রাশিয়ার ভবিষ্যত নেতা অ্যালেক্সাই নাভালনি

রুশ অর্থনীতিবিদ সার্গেই গুরিয়েভ মনে করেন, নাভালনিকে নিয়ে ক্রেমলিনের ভয়ের কারণ দুটি। প্রথমত, তিনি অনেক বছর ধরে সরকারি দুর্নীতি তুলে ধরছেন। তার এই কার্যক্রমের মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে পুতিনের জনসমর্থনের ওপর। দ্বিতীয়ত, নাভালনি রাশিয়ার বর্তমান শাসনব্যবস্থার একটি জুতসই বিকল্প।

বিরোধী নেতা নাভালনি রাশিয়ার রূপান্তরের জন্য একটি বাস্তবসম্মত ও আধুনিক পরিকল্পনা দিয়েছেন। রাশিয়ার উন্নতি-অগ্রগতি-পরিবর্তনের জন্য কী করতে হবে, তা বলেই বসে থাকেননি নাভালনি; একই সঙ্গে কাজগুলো কীভাবে করা হবে, তাও বাতলে দিয়েছেন।

সাবেক মানবাধিকার আইনজীবী ও কলাম লেখক আমন্ডা টাব মনে করেন, নাভালনি রাশিয়ার অন্য সব রাজনীতিবিদের মতো নন। তিনি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির রাজনীতিবিদ। তিনি সত্যিকারের একজন বিরোধী নেতা, যার তৃণমূলে সমর্থন রয়েছে। যার দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আছে, তার কৌশল ইতিমধ্যে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে তার মধ্যে আছে ক্যারিশমা। সবকিছু মিলিয়ে পুতিনের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভীতির কারণ হয়ে উঠেছেন নাভালনি।

অ্যালেক্সাই নাভালনির পক্ষে আসলে কারা?

কাউন্সিল ফর ইউরোপের সঙ্গে এক ভিডিও বৈঠকে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানিয়েছেন যে জার্মানি চেষ্টা করছে যাতে নাভালনি উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পান৷ এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে কারাগারে যদি নাভালনির মৃত্যু হয় তাহলে রাশিয়াকে কঠোর পরিণাম ভোগ করতে হবে৷

ইউরোপাীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তার মধ্যে রাশিয়ান ফেডেরেশনের ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির প্রধান আলেকজান্ডার বাস্ত্রিকিন আছেন। এছাড়াও প্রসিকিউটর জেনারেল ইগোর ক্রাসনোভ, ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান ভিক্টর জোলোটোভ, ফেডারেল প্রিসন সার্ভিসের প্রধান আলেকজান্ডার কালশনিকভ আছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাতজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই সঙ্গে ১৩টি কোম্পানি বা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। অ্যামেরিকার দাবি, ওই সংস্থাগুলি নার্ভ গ্যাস এবং বায়ো অস্ত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

এফবিকে নিষিদ্ধের নেপথ্যে

ফাউন্ডেশন ফর ফাইটিং করাপশন (এফবিকে) নিষিদ্ধ করে মস্কো সিটি কোর্টের রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিসেবে আখ্যয়িত করেছেন নাভালনি সমর্থকরা। তারা বলছেন, আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনের কয়েক মাস আগে পুতিন-বিরোধীদের স্তব্ধ করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে এই রায় দেওয়া হয়েছে।

কী চায় পুতিন সরকার?

নাভালনির সংগঠনগুলোকে উগ্রপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করায় সরকারের পক্ষে সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত অ্যাক্টিভিস্ট ও তহবিলদাতাদের বিচারের আওতায় এনে দীর্ঘ সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মুখপাত্র আলেক্সি জাফেয়ারভ বলেন, এই সংগঠনগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শত্রুতাকে প্ররোচিত করে এমন তথ্যই শুধু ছড়িয়ে দেয়নি বরং তারা চরমপন্থী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।

হত্যাচেষ্টার শিকার অ্যালেক্সাই নাভালনি

২০২০ সালের আগস্টে হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন নাভালনি। সে সময় তিনি সাইবেরিয়ার টমসক শহর থেকে উড়োজাহাজে করে মস্কোয় ফিরছিলেন। যাত্রাপথে উড়োজাহাজেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে বহনকারী প্লেনটি সাইবেরিয়ার ওমস্কে জরুরি অবতরণ করে। সেখানকার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। তিনি কোমায় চলে যান। পরে চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানির বার্লিনে নেওয়া হয়। সেখানে ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন তিনি।

অ্যালেক্সাই নাভালনি : বিষ প্রয়োগের জন্য কে দায়ী?

বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মান বিশেষজ্ঞরা জানান, নাভালনিকে রাশিয়ান নার্ভ এজেন্ট ‘নোভিচক’ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

পরে সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞরা তাকে নভিচক নামে স্নায়ু বিকল করার বিষাক্ত এক রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছে বলে অভিমত দেন।

বিষ প্রয়োগের জন্য সরাসরি পুতিনকে দায়ী করেন নাভালনি। তবে পুতিন এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করেছে ক্রেমলিন।

অ্যালেক্সাইনাভালনি :গ্রেফতার ও  কারাদণ্ড

গ্রেফতারের হুমকি উপেক্ষা করে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি জার্মানি থেকে দেশে ফেরেন নাভালনি। বিমানবন্দরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। আটক হওয়ার কয়েক মিনিট আগে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু ভয় পাই না।’

২০১৪ সালে অর্থ আত্মসাতের পুরোনো জালিয়াতির মামলায় হওয়া সাজা স্থগিতের শর্ত লংঘনের জন্য তাকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় মস্কোর একটি আদালত।

নাভালনির স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি

রাশিয়ার কারাবন্দী বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। নাভালনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে আছেন। এ জন্য যে কোনো সময় নাভালনির ‘মৃত্যু’ হতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার চিকিৎসক জেরোস্লাভ আশিকহিমিন।

তার শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি, এ কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। এছাড়া, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।

নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়ার পরিচয়

অ্যালেক্সাই নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া। নাভালনি কোমায় চলে যাবার পর তাকে রাশিয়ার হাসপাতালে নেয়া, সেখান থেকে জার্মানিতে নিয়ে আসা এবং সুস্থ হয়ে যাবার পর আবার স্বামী দেশে ফেরার সময়টায় বলতে গেলে নিয়মতিই খবরে ছিলেন তিনি৷

ইউলিয়া নাভালনায়া হচ্ছেন নাভালনির মুখপাত্র। নাভালনি তখন বার্লিনের চারিটে হাসপাতালে৷ প্রতিদিন দেশি-বিদেশি শত সাংবাদিকের ভিড় সেখানে৷ সবার প্রশ্ন- কেমন আছেন তিনি? জ্ঞান ফিরেছে? কবে ছাড়া পাবেন? প্রতিদিন এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন ৷

স্বামী মৃত্যুশয্যায়৷ আবেগ গোপন করতে সবসময় চোখে রাখতেন কালো চশমা আর কণ্ঠে দুঃসময়কে জয় করার অবিচল দৃঢ়তা৷

কোমা থেকে জীবনে ফেরার পর ইন্সটাগ্রামে ‘তুমি আমায় বাঁচালে’ কথাটি লিখেছিলেন আলেক্সি নাভালনি৷ ‘ইউলিয়া, তুমি আমায় বাঁচালে’ কথাটা ছিল ইউলিয়ার ২০তম বিবাহবার্ষিকীর সেরা এবং একমাত্র উপহার৷

নাভালনি কোমায় যাবার পর থেকে বার্লিনের হাসপাতাল ছাড়া পর্যন্ত চরম বিপদেও অবিচল থেকেছেন ইউলিয়া৷ স্বামীর গালে চুমু দিয়ে তাকে রুশ পুলিশের সঙ্গে কারাগারে পাঠানোর পর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করা ইউলিয়া বলেন, ‘‘আলেক্সি আর আমি ভয় পাইনি৷ আপনারাও ভয় পাবেন না৷’’

নাভালনিকে রক্ষায় সাহসি ভূমিকার জন্য ইউলিয়া নাভালনায়াকে ২০২০ সালের ‘অন্যতম সেরা অবিসংবাদিত নায়ক’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া নোভায়া গাজেত্তা পত্রিকা৷ তারা মনে করে, নাভালনির ভাগ্য ভালো যে এমন একটি স্ত্রী পেয়েছে৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষক কন্সটানটিন কালাচেভ মনে করেন, ‘‘আলেক্সি যেহেতু গ্রেপ্তার, এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে৷’’

তার মতে, অনেকের কাছে এখন ইউলিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নাভালনির চেয়েও বেশি৷ তিনি মনে করেন, পুতিনের বিরুদ্ধে একই লোক দেখতে দেখতে মানুষ খুব বিরক্ত৷ সেই একঘেয়েমি শেষ করে ইউলিয়ার সামনে পুতিনবিরোধী নতুন নেতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে৷

তথ্যসূত্র