প্রথম আলো না ফরেন অ্যাফেয়ার্স কার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য?

মোদির ওয়াশিংটন সফর

44
প্রথম আলো না ফরেন অ্যাফেয়ার্স কার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য?

আজ প্রথম আলো নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধির পাঠানো এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু হচ্ছে- বাংলাদেশের আগামি নির্বাচনের বিষয়টি বাইডেনের কাছে তুলে ধরবেন মোদি। যেখানে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চেয়েও গুরুত্ব পাবে ভারতের স্বার্থ। কিন্তু মোদির ওয়াশিংটন সফরের আগে Foreign Affairs Magazine ১৬ তারিখে India as It Is : Washington and New Delhi Share Interests, Not Values শিরোনামে Daniel Markey এর একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। সেখানে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখছি। বরং গণতন্ত্রের জন্য মোদিকে যুক্তরাষ্ট্র চেপে ধরতে পারে এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আসুন আমরা Foreign Affairs এর প্রতিবেদনের কিছু অংশ দেখে নিই।

১.
“নয়াদিল্লী ওয়াশিংটনকে হতাশ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে তাদের দহরম মহরম কমেনি। অর্থনৈতিক ফোরাম ব্রিকসে যোগ দিয়েছে তারা, যেটা মার্কিন স্বার্থবিরোধী। এখনও মস্কোর পাশ ছাড়েনি তারা। ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্র কিছুদিন আগেই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ সিস্টেম কিনেছে ভারত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকিকে তোয়াক্কা করেনি। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার তেল কেনা আরও বাড়িয়েছে। জাতিসংঘে মস্কোর বিরুদ্ধে কোন ভোটেই তারা অংশ নেয়নি। ইউক্রেন নিয়ে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই পছন্দ করেনি। এমনকি সেখানে যারা দিল্লির পক্ষে কথা বলে, তারাও ভারতের আচরণে হতাশ।”

২.
“ ইউক্রেন ইস্যুর চেয়েও ভারতের বড় অবনতি হয়েছে গণতন্ত্রে। মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিভিল আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণ করা হয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, সেগুলোকে শক্তিহীন করা হয়েছে। পার্লামেন্টে দলীয় তাবেদারির রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে। মিডিয়া, একাডেমিয়া, বা সিভিল সোসাইটির সমালোচনাও মোদি সহ্য করতে পারেন না। গুজরাট গণহত্যায় মোদির ভূমিকা তুলে ধরায় বিবিসির ডকুমেন্টারি তারা নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বে গণতন্ত্রের মান নিয়ে যারা কাজ করে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় তিন প্রতিষ্ঠান হলো – ভি-ডেম ইন্সটিটিউট, ফ্রিডম হাউজ, আর ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট। তিন প্রতিষ্ঠানের সূচকেই ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গেছে। ”

৩.
“ভারত স্বৈরাচারি হয়ে ওঠায় যুক্তরাষ্ট্রের নানা সমস্যা হচ্ছে। দিল্লির ব্যপারে তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পররাষ্ট্রনীতির জন্য জনগণকে জবাব দিতে হয়। ভারতে সেটা হচ্ছে না। দিল্লি যত হিন্দুবাদী হচ্ছে, ভারতের নিরাপত্তা তত কমছে। ভারতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। রয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দীর্ঘ ইতিহাস। সেখানে সংখ্যালঘুদের দমনের অর্থ হলো তাদেরকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া। ”

৪.
“বিজেপির গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখেও মোদি সরকারের সমালোচনায় বাইডেন প্রশাসন কখনও মুখ খোলেনি। কারণ, বাইডেন মনে করেন, ভারতের নীতি নিয়ে কিছু বললে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে। তবে, ভারতের সমালোচনা না করার জন্য অন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। ভারত শুধু তথাকথিত গণতন্ত্র নয়, এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কের আড়ালে তারা যদি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে পার পেয়ে যায়, তাহলে অন্য দেশগুলোও সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হবে। ভারতের গণতন্ত্রের পতন তাই অন্য অনেক দেশকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহসী করেছে। দিল্লির ব্যপারে নিরবতার কারণে বাইডেন প্রশাসনকে নিজের দেশেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।”

৫.
“মোদি সরকারের তোষণ করা ওয়াশিংটনকে ছাড়তে হবে। তাদের ছত্রছায়ায় আরেকটি এশিয় দানবের যাতে উত্থান না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ভারত সরকারকেও বুঝতে হবে, দেশের ভেতরে অন্যায় আচরণের কারণে ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ভারতের ভোটারদেরও এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।”

৬.
“ ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে আরও বেশি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। যাতে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা সেগুলো থেকে ভারতের ব্যপারে সঠিক ধারণা নিতে পারে। এই প্রতিবেদনগুলোকে তথ্যগতভাবে নির্ভুল হতে হবে, যাতে ভারতীয় কূটনীতিকদের অভিযোগের জবাব দেয়া যায়। মার্কিন সমালোচনায় ভারতের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবলে চলবে না। ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী অংশীদার হতে হলে উভয় পক্ষকে ভিন্নমত সহ্য করা শিখতে হবে। ভারতের কূটনীতিকরা যেমন সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের অবস্থান বুঝিয়ে দেয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও তেমন দ্ব্যর্থহীনভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। মোদ্দা কথা হলো, সত্যিকারের অভিন্ন স্বার্থ নিয়ে চলতে হবে, কাল্পনিক মূল্যবোধের গালগল্পে কোন পক্ষেরই কোন লাভ হবে না “

ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটি গনমাধ্যমের এই মনোভাবে সেখানে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত কিভাবে দঁড়াবে তা এক বড় প্রশ্ন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক বলছেন, “ প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাবেন আঞ্চলিক স্বার্থে হাসিনার ক্ষমতাসীন থাকার অর্থ কী। তাঁর ক্ষমতাসীন থাকা না-থাকার ওপর আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নটি যে গভীর সম্পর্কযুক্ত, সে কথা বাইডেনকে মোদি জানাবেন বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর। বোঝাবেন, এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে আঞ্চলিক অপশক্তি উৎসাহ পায়।

ভারতের দ্বিতীয় চিন্তা চীনকে নিয়ে। এশিয়ার এই বৃহৎ শক্তিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও চিন্তিত। বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট। যদিও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত বোঝাবে, সেই ভারসাম্য কিংবা আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এমন কিছুর জন্য বাংলাদেশকে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবে না। চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সে কথাও বোঝানো হবে।”

সেই পুরানো কথা। ইসলামি মৌলবাদের উত্থানের গালগল্প এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এজেন্ডায় নেই। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যহারের মাধ্যমে এই এজেন্ডার সমাপ্তি ঘটেছে। মজার ব্যাপার হলো আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি ভারতকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের পর আফগানিস্তানে ভারতের পুরো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তছনছ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে ভারত। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মনখারাপ করা ছাড়া ভারতের আর কিছুই করার ছিলো না।

এবার থাকলো চীন প্রসঙ্গ। ভারত যদি জানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের বিজয়ী হওয়া কঠিন। সে বিষয়টি নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রও জানে। তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশের তো চীনের কোলে উঠার আর ঝুকি থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র তো সেটাই চাইবে।

আসলে প্রথম আলো এই প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটালো মাত্র। বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ন ও জটিল সময়ে প্রথম আলো সব সময় ভারতের নীতির পক্ষে প্রচার চালায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এছাড়া ভারতীয় বেশিরভাগ সাংবাদিক প্রবলভাবে জাতিবাদী ও উদার চিন্তারবিরোধী। তারা ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের সাহস রাখেনা। প্রথম আলোর সৌম্য বন্দোপাধ্যয় সেই কাজটি করেছেন মাত্র।

লেখক : সাংবাদিক