‘অখণ্ড ভারতকে ভিত্তি ধরে লেখা হয়েছে মাধ্যমিকের ইতিহাস বই’

11
অখণ্ড ভারতকে ভিত্তি ধরে লেখা হয়েছে মাধ্যমিকের ইতিহাস বই


নতুন স্কুল কারিকুলামে,৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান গ্রন্থে যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তা ‘অখণ্ড ভারত’ বয়ানকে ভিত্তি ধরে লেখা হয়েছে। খুবই কৌশলে লেখা হলেও বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের নূন্যতম ধারণা যাদের রয়েছে তারা বিষয়টি ধরে ফেলতে পারবেন।
এ বয়ানের জনক হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬)। যাকে ‘হিন্দু ইতিহাস তত্ত্বের’ জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটা জ্ঞানচর্চার মহলে ‘হিন্দুত্ব’ (Hinduttva) কিংবা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ হিসেবেও পরিচিত। ‘অখণ্ড ভারত’ বা ‘হিন্দুত্ব’ (Hinduttva) হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও ভূগোল ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক মতবাদ যার মূল কথা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্থান) একটি অখণ্ড প্রাচীন ভূখণ্ড বা ভারতবর্ষ যা হিন্দুদের পবিত্র ভূমি ও হিন্দু সভ্যতার সূতিকাগার। এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, মুসলমানদের (মুসলিম লীগ) সঙ্গে খ্রিষ্টানদের (ব্রিটিশ) আঁতাত ও ভারতীয় কংগ্রেসের আপোষকামীতার ফলে ১৯৪৭ সালে এই ভূখণ্ড খণ্ডিত হয়ে গেছে। বর্তমান যে ভারত তা ‘খণ্ডিত’। ধাপে ধাপে এই ভূমি তাঁরা পুনরুদ্ধার করে এক ও অবিভাজ্য হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই হবে অভীষ্ট লক্ষ্য। এই মতবাদ অনুযায়ী খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা হলো বহিরাগত ও আক্রমণকারী (Savarkar, V.D. 1923. Hinduttva. Veer Savarkar Prokashan. Bombay.; Savarkar, V.D. 1971. Six Glorious Epochs of Indian History, trans. S.T. Godbole, BalSavarkar, Bombay.; Mishra, A. 2022. Locusts vs. the gigantic octopus: the Hindutva international and “Akhand Bharat” in V.D. Savarkar’s history of India, India Review, 21:4-5,512-545)

২.
ইতিহাসের নিরিখে ‘অখণ্ড ভারত’ হলো একটি কল্পিত ভূখণ্ড যা ইতিহাসের কোনো কালপর্বেই এক ও অখণ্ড ছিল না। বিশেষত, ঐতিহাসিক কালপর্ব আনু.৫০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ থেকে ১৮০০ শতক সময়কালের ভেতরে ভারতের বর্তমান যে ভূখণ্ড সেই ভূখণ্ডটিই কখনো একক শাসনাধীনে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় না। মৌর্য থেকে মোগল পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার বছরের ভারতীয় ইতিহাসে মোগলদের সাম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। বলা হয়ে থাকে যে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ভারতের জিডিপি ছিল পৃথিবীর মাঝে সর্বোচ্চ। অখণ্ড ভারতের কল্পিত সীমানা সেই মোগলদের সময়েও ছিল না।

৩.
এ বইগুলোতে প্রাচীন ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে ‘বাংলা অঞ্চল’ নামের একটি কল্পিত ভূখণ্ডের, যার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমানা নাই। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের ৫১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘এই বাংলা অঞ্চল আর আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়। বাংলা অঞ্চলেরই পূর্ব অংশে আমরা বাস করি। আবার এই কল্পিত বাংলা অঞ্চলকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কল্পিত সেই অখণ্ড ভারতের পূর্বাংশে। অর্থাত এই কল্পিত বাংলা অঞ্চল আদতে ভারতবর্ষের অংশ। ৭ম শ্রেণির বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘বাংলা অঞ্চল ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের পূর্ব অংশ’। একই গ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে কীভাবে অখণ্ড ভারত থেকে কালক্রমে বাংলা নামে ভূ-খণ্ডের উৎপত্তি হয়েছিল-‘ভারতবর্ষের পূর্বাংশে অবস্থিত বাংলা অঞ্চল। এই বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন ‘বঙ্গ’ জনপদ থেকে ধীরে ধীরে ‘বঙ্গাল’ তারপর ‘বাঙ্গালা’ এবং ১৮ শতক থেকে ‘বেঙ্গল’ নাম-পরিচিতি গড়ে উঠেছে’। পুরো পাঠ্য বই জুড়েই যে মানচিত্রগুলো দেওয়া হয়েছে সেখানেও বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একটি একক ভূখণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করে, তার ভেতরে বাংলাদেশ/বাংলা অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়েছে যাতে করে শিশু মানসপটে এটি ঐতিহাসিকভাবে একটি অখণ্ড ভূখণ্ড হিসেবে গেঁথে থাকে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইতে ৬৬ পৃষ্ঠায় খুব স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের প্রাচীন ভৌগোলিক পরিচয়টা দেওয়া হচ্ছে এভাবে-‘ইতিহাসের আলোকে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রাচীনকালে যে ভূখণ্ড-ভারতবর্ষ নামে পরিচিত ছিল সেই ভূখণ্ড-এখন দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশ নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে মোট আটটি রাষ্ট্র রয়েছে। এগুলো হলো-আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপ’। অর্থাৎ একটা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কল্পিত অখণ্ড ভারতবর্ষ হিসেবে, যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই এবং আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আদতে ছিল এই কল্পিত অখণ্ড ভারতের অংশ অবিচ্ছেদ্য অংশ!

৪.
ইতিহাস লিখতে হলে প্রয়োজন হয় ‘উপাত্ত’ বা ‘প্রমাণ’। সেটা হতে পারে লিখিত কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এরুপ কোনো নিদর্শনই পাওয়া যায় নাই যা দিয়ে এই বিতর্কিত ন্যারেটিভ দিয়ে প্রাচীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা যায়। বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস যারা লিখেছেন কারো লিখনিতেই এ ধরনের বয়ান পাওয়া যায় না। এধরনের ইতিহাস, ইতিহাসের বিকৃতি। এটি চুড়ান্তভাবে অনৈতিহাসিক এবং কল্পকাহিনীর নামান্তর। উপরন্তু, এ ধরনরে ইতিহাস স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অখন্ডতা ও জাতীয় সংহতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংকটের কারণ হতে পারে।

আশা করি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন। এই ধরনের বিকৃত ইতিহাস কোনক্রমেই স্কুলের পাঠ্য হতে পারে না। বইগুলোর আমূল সংস্কার করতে হবে। যিনি এই ইতিহাস লিখেছেন তাকে বাদ দিয়ে দেশের প্রথিতযশা প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। এ ধরনের দেশ বিরোধী বিকৃত ইতিহাস কিভাবে এবং কেন লেখা হলো সেটারও তদন্ত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।