সাঈদী ইস্যুতে তারেক রহমানের স্মার্ট সিদ্ধান্ত

72
তারেক রহমান-সাঈদী

১.
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো নানাভাবে বিভক্ত। নারী-নেতৃত্ব নিয়ে আলেমদের মধ্যে আছে নানা মত। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে এই বিভক্তির পরও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলগুলো দীর্ঘসময় রাজনীতি করেছে। যেখানে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও নুর হোসাইন কাসেমীর মতো আলেমরা ছিলেন। এছাড়া, জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সাথে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে সক্রিয়।

বেগম খালেদা জিয়া কীভাবে ভিন্নমতের আলেমদের সাথে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলেন, তা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গবেষণার বিষয়। এই আলেমরা কখনও বেগম খালেদা জিয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। আবার খালেদা জিয়া কোনো ধরনের হিপোক্র্যাসির আশ্রয়ও নেননি। আলেমদের নিয়ে কখনও অসম্মানসূচক বক্তব্য দেননি। তাকে কখনও হিজাব পরতে হয়নি, আবার ধর্মের আবেগতাড়িত কোনো বক্তব্যও রাখতে হয়নি। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই বলতেন। নিজের অবস্থানে তিনি ছিলেন সবসময় দৃঢ়।

বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল একটি মুসলিম দেশে বেগম খালেদা জিয়া আলেমদের নিয়ে চলার যে বহুমতের পথ তৈরি করেছিলেন, তার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ন্যায্যতা তৈরি হয়েছিল। ইসলামপন্থীরা তার নেতৃত্ব নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলেননি। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এই কার্ডটি খেলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। আলেম সমাজের এই ভূমিকা এরশাদের পুরুষ নেতৃত্বের চতুর কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির এই অবস্থান সাধারণ মানুষের কাছে দলটির ভিত্তিকে মজবুত করেছে। বেগম খালেদা জিয়া হয়েছেন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের ঐক্যের প্রতীক।

২.
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে শোক বিবৃতি দিয়েছেন, তা দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কারণ, মাওলানা সাঈদীর গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব শুধু জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল না, তিনি এই গন্ডি অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। তারেক রহমান এই বিবৃতি তাদের আবেগকে ধারণ করেছে। সত্যিই এটি একটি স্মার্ট মুভ। একইসাথে এই বিবৃতি জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে। রাজনৈতিক মিত্রের জন্য এই বার্তা খুবই কার্যকর ও সঠিক পদক্ষেপ।

৩.
বাংলাদেশের সমাজে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তারেক রহমান বিদেশে থেকেও তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। তিনি সম্ভবত সমাজের নানাস্তরের লোকের সাথে কথা বলে বাংলাদেশের সমাজের নীরব পরিবর্তনগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন। ওয়ার অন টেররের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা ইসলামপন্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চালিয়েছেন, তাতে এ-দেশের তরুণদের বিরাট অংশের মধ্যে মুসলিম আইডেন্টিটি ও ধর্মের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এই তরুণরা কোনো ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের আহ্বানে মুসলিম আইডেন্টিটি সামনে নিয়ে আসছে না। তারা নিজেরা মনে করছে, ক্ষমতাসীনরা যেভাবে অন্যায় আচরণ করছে, তাতে মানুষের ধর্মীয় পরিচয় নানাভাবে বিপন্ন হচ্ছে। ফলে, এই তরুণরা ধর্মের প্রতি আরও বেশি অনুরক্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু এ-জন্য কোনো ইসলামপন্থী দলের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে, তা তারা মনে করেনি। তারা ধর্মীয় পরিচয় ধারণ ও ধর্মপালনকে জীবনের একটি অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছে।

বিএনপি যে তারুণ্যের সমাবেশ করেছে, সেখানে শুক্রবারের সমাবেশগুলোতে জুমার সময় প্রায়সব তরুণকে নামাজ পড়তে দেখা গেছে। আশির দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণদের এভাবে মসজিদমুখী হতে দেখা যায়নি। তারেক রহমান নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার দিকটি ভালোভাবে ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয়।

৪.
মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়েছে। এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীতে এমন কোনো নেতা নেই, যিনি একসাথে লাখ লাখ মানুষকে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। এছাড়া, জামায়াতে ইসলামীতে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের সংকট প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।

সত্তর দশকের শেষদিক থেকে আশির দশকের পুরো সময় জামায়াত ও শিবিরের নেতৃত্বে মেরিটোক্র্যাসির প্রভাব ছিল, যা বহু মেধাবী তরুণকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। কিন্তু, এখন তাতে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। খুব সহজে এই শূন্যতা পূরণ না-ও হতে পারে। ফলে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তরুণদের কাছে বিএনপি আরও বেশি আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠতে পারে। তারুণ্যের সমাবেশগুলো এরইমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছে, বিএনপির প্রতি তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে।

লেখক : সাংবাদিক