সিংক হোল কী? এটা কিভাবে তৈরি হয়?

902
সিংক হোল কী? এটা কিভাবে তৈরি হয়?

ধরুন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করেই আপনার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। অথবা আপনি যে বাড়িতে থাকছেন, সেটিই হঠাৎ মাটির নিচে তলিয়ে গেল। ভীতিকর কল্পনা না? হ্যাঁ, বলছি সিংক হোল সম্পর্কে। সিংক হোল খুব কমই ঘটে। তবে তারা আঘাত করলে ট্র্যাজেডি তৈরি হতে পারে। সিংক হোল অনেক কারণে ঘটে। এ সম্পর্কে জানুন, নিজেকে শিক্ষিত করুন।

সিংক হোল কী?

সিংক হোল (sinkhole) বা সোয়ালো হোল হচ্ছে- প্রকৃতিতে হঠাৎ তৈরি হওয়া বিশাল আকার গর্ত। কোনোরকম পূর্বাভাস বা সংকেত ছাড়া মাটি ডেবে যাওয়া, বিশাল গর্তের সৃষ্টি হওয়া, পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি মাটির নিচে চলে যাওয়া, মুহূর্তেই বিশাল স্থাপনা ধ্বংস হওয়া, একটি শহরের বড় অংশ বিলীন হওয়া, ফসলি জমিতে দানবাকৃতির গর্ত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি ঘটনাকে এক শব্দে প্রকাশ করা যায় সিংক হোল নামে। নামটি অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও পৃথিবীর উপরিভাগের পৃষ্ঠে গভীর গর্ত সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে সম্প্রতি এই বিষয়গুলো খুব বেশি ঘটছে।

সম্প্রতি সিংক হোল নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে তুরস্ক। দৈত্যাকার গর্তগুলো গিলে খাচ্ছে তুরস্কের কোনিয়া রাজ্যের বিস্তৃত কৃষি জমি। চোখের পলকেই মাটির গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষকের জমি ও ফসল।
গত ১ দশকে এই অবস্থার অবনতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালেও তুরস্কের এই অঞ্চলে সিংক হোলের সংখ্যা ছিলো ৩৬০টি। যা এই বছরেই হু হু করে বেড়ে হয়েছে ৬০০টিতে।এক একটি গর্ত ১০ মিটার চওড়া ও ১৫০ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়। গভীর কুয়োর মতো গর্তগুলো এখন রীতিমতো মৃত্যু ফাঁদ।

সিংক হোল কেন হয়?

কিন্তু প্রশ্ন হলো দৈত্যাকার গর্তগুলো তৈরি হওয়ার কারণ কী?

সিংক হোল তৈরি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তবে সাধারণত মাটির নিচের পানির সাথে ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় শিলাস্তর ক্ষয় হয়। এই ক্ষয় থেকেই তৈরি হয় ভয়ঙ্কর গর্ত।

মাটির নিচে যেখানে চুনাপাথর, কার্বনেট শিলা, লবণের স্তর, পাথর, বালি ইত্যাদি বেশি পরিমাণে রয়েছে সেখানে সিংক হোল বা বিশাল আয়তের গর্ত সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত হয়। শিলা দ্রবীভূত হলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গা বৃদ্ধি পায়। ক্রমে ক্রমে ফাঁকা স্থানের বৃদ্ধির ফলে মাটির উপরিভাগের ভার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। একসময় উপরিভাগের ভূমিধস ঘটে সিংক হোল সৃষ্টি হয়।

একেকটি সিংক হোল আয়তনে কয়েক ফুট থেকে কয়েকশ’ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, যা তৈরি হতে সময় লাগে কযেক দশক থেকে শতাব্দী। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সিংক হোলগুলো মাটির গঠন ও এর অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন ধরনের খনিজ ও শিলার উপর ভিত্তি করে কয়েক ধরনের হতে পারে; যেমন- ডিসসল্যুশন সিঙ্কহোল, কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোল এবং কভার কোলাপ্স সিঙ্কহোল।

এছাড়া বৃষ্টি হলে ভূমির উপরিভাগের পানি মাটির গভীর স্তরে প্রবেশ করে। এরপর বৃষ্টির পানি মাটির একটি স্তরে জমা থাকে। এরপর পানি যখন সেচ কাজ বা অন্য কোনো কারণে উত্তোলন করা হয় তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে গর্ত তৈরি হতে পারে।

তবে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তৈরি হওয়া সিংক হোলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানবসৃষ্ট। মাটির নিচে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ ও পানির লাইন প্রধানত এর জন্য দায়ী। আমাদের জীবন বাঁচানো এই পানির লাইনগুলোই একসময় আমাদের জন্য হুমকির কারণ হয়। বছরের পর বছর ধরে মাটির নিচে থাকা পানির লাইনে যখন কোনো লিকেজ বা ফুটো হয়, তখন সেখান থেকে পানি চুয়ে চুয়ে মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মাটির নিচে জলধারা সৃষ্টি করে।

এভাবে বছরের পর বছর চলতে থাকে এবং জলধারা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এছাড়াও মাটির উপরের বৃষ্টির পানি মাটি চুয়ে পড়ে সেখানে গিয়ে যোগ হয় এবং একসময় মাটির নিচের জলধারা বিশাল আকার ধারণ করে। মাটির উপরের স্তরে যখন বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়, তখন এই ভার অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলে সেখানকার স্থাপনা মাটির নিচে বিশাল গর্তে নিমজ্জিত হয়ে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি করে।

সিংক হোল কোন অঞ্চলে বেশি দেখা যাচ্ছে?

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো সিংক হোল কখন তৈরি হবে তা কেউ জানে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে এই হোল।

এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অসংখ্য সিংক হোল তৈরি হয়েছে। সেগুলোর প্রভাবে বিলীন হয়েছে নানা জীববৈচিত্র্য ও সভ্যতা। সবচেয়ে বেশি সিঙ্কহোল দেখা যায় আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আমেরিকার মধ্যে ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, কেন্টাকি, টেক্সাস ইত্যাদি অঙ্গরাজ্যগুলোতে।

তুরস্কের কোনিয়া রাজ্যেও ব্যাপক হারে সিঙ্কহোল বাড়ছে, গত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে সিঙ্কহোলের সংখ্যা। এছাড়া ক্রোয়েশিয়া, ইতালি, মেক্সিকো, ইসরায়েল, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে অসংখ্য সিঙ্কহোল।

বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম সিংক হোল রয়েছে চীনে। ‘জিয়াওজাই তিয়ানকেংগ’ নামের এই সিংক হোলের অবস্থান চুনকিংয়ের ফেনজি কাউন্টে, যার গভীরতা প্রায় ৬৬২ মিটার ও প্রস্থ ৫১১ মিটার।

তুস্করের কোনিয়া রাজ্যের এসব সিংক হোলের কারণ আপাত প্রাকৃতিক মনে হলেও আসলে এর জন্য কৃষকরাই দায়ী বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

কোনিয়া টেকনিক্যাল ইউভার্সিটির সিংক হোল গবেষণা -এর অধ্যাপক ফিতুল্লাহ আরিখ বলেন, তিনি রাজ্যটিতে গণনা করে ৬০০টি সিংক হোলের অস্তিত্ব পেয়েছেন। কোনিয়া রাজ্য বিখ্যাত হলো গম উৎপদনের জন্য। এই অঞ্চলে রমরমা চাষ হয় গমের। খরার জন্য চাষাবাদের কাজে ভূ-অভ্যন্তরের পানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে কৃষকদের।

অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে নেমে গেছে পানির স্তর। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে। তাই হুমকির মুখে পড়েছে জমির তলার ভীত। আবার ওই অঞ্চলের কৃষকেরা সেচের সুবিধায় পানি তুলে ডোবায় জমা করে রাখেন এতে মাটির শক্তি কমে গিয়েও এসব ডোবার জায়গায় তৈরি হয় সিংক হোল। এসব গর্তের নিচের অংশ গভীর এবং অস্থিতিশীল হওয়ায় গর্ত ভরাট করাও অসম্ভব।

সিংক হোল কি এড়ানো সম্ভব?

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে খুব বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে। সিসিংক হোল বাড়ার পেছনে প্রাথমিক কারণ হিসেবে ভূগর্ভস্থ পানির অধিক উত্তোলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূগর্ভের পানি মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ধসে পড়ছে মাটি।

এছাড়াও খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কারণে সিঙ্কহোল সৃষ্টি হতে পারে। আরো একটি উদ্বেগজনক কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। এর ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং খরা, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো বৈরিতার সৃষ্টি হয়।

এমন করে যদি সিংক হোলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তবে পৃথিবী দিন দিন আরো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। যদিও সিঙ্কহোল সৃষ্টি হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তবে এটা সত্য যে, প্রকৃতির প্রতি আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা আর অবহেলার প্রভাবেই দিন দিন সিংক হোলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সূত্র :