অস্ত্র উদ্ধার : ইয়ে কাহানি ফের সহি

44

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের আঁতাতের নির্বাচনের সরকার এবং বর্তমানের অনির্বাচিত সরকার নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়। এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠে যায়, তখনই দৃষ্টি ফেরানোর জন্য সরকার হেন কোনো অপকৌশল নেই যার আশ্রয় নেয় না। কখনো র‌্যাবের হাতে অর্থের বিনিময়ে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটে, কখনো টিকাটুলীতে পীর সাহেব জবাই হন। কখনো টিভি উপস্থাপক খুন হন। কখনো গুম হয়ে যান ইলিয়াস আলী, সালাহউদ্দিনের মতো প্রতিশ্রুতিশীল নেতারা। কখনো বৌদ্ধপল্লীতে নিজেরা হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে সরকার। কখনো নিজেরাই মন্দির ভেঙে তোলপাড় সৃষ্টি করে। কখনো বা ইসলাম ও আল্লাহ-রাসূলের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণকারী ব্লগার খুন হয়ে যান। ডিবি পরিচয়ে এসে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে যায় সরকারের লোকেরা। রাত ৯টায় টিএসসি মোড়ে পুলিশের একেবারে চোখের সামনেই তিন স্তরের নিরাপত্তা ভেদ করে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। আর যদি নিদেনপক্ষে কিছুই না পাওয়া যায় তখন সরকার একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালু করে দেয়।
বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান খেলতে যাওয়া নিয়ে কত সমস্ত দেশপ্রেমের বুলি যে শুনলাম, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের জুয়াড়িরা যখন খেলে নয়, আম্পায়ার কিনে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিলো, সরকার কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারল না। তবে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ও আইসিসি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল দু-চার কথা বলেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলাদেশের চৌকস খেলোয়াড় মাহমুদউল্লাহকে ভারত আম্পায়ার কব্জা করে অকারণেই আউট দিয়ে দেয়। একইভাবে দু-দু’টি ভারতীয় প্লেয়ারের নিশ্চিত আউট ঠেকিয়ে দেয়। ফলে ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে। ভারত যদি খেলে জিতত, তাহলে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা দুঃখ পেলেও ক্ষুব্ধ হতো না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে জালিয়াতি করে জয় ছিনিয়ে নেয়ায় টিএসসি এলাকায় শত শত প্রতিবাদী তরুণ-তরুণী ভারতের বিরুদ্ধে জুতা মিছিল করে। অর্থাৎ ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে তারা চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের নাটক সাজিয়ে ভারত বেশ জজবা তুলেছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে নটনটী গায়কেরা পর্যন্ত এসে তাদের তাল দিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতের কংগ্রেস সরকার মনে করেছিল, বাংলাদেশের তারুণ্য সম্পূর্ণরূপে ভারতের দখলে এসে গেছে। সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশ দখলে আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু ভারতের এই ষড়যন্ত্র যারা টের পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমও ছিলেন। তিনি লিখে ও বলে এর প্রতিবাদ করে গেছেন। খুব স্পষ্ট করে তিনি বলেছিলেন যে, এটি তরুণসমাজের বিভ্রান্তি এবং সরকার স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে একধরনের তামাশা করছে। মুক্তিযুদ্ধ মানে মেয়েদের লাঠিখেলা, নাচ-গান, জারি-সারির আসর ছিল না। সরকার সেটাকে তেমনই এক আসরে পরিণত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সহযোগিতা কোনো নিঃস্বার্থ প্রেম ছিল না। তা যদি থাকতই, তাহলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ইন্দিরা গান্ধী তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় এ কথা কিছুতেই বলতেন না যে, ‘হাজার সাল কা বদলা লে লিয়া।’ সে হাজার সালের বদলাটা কী? সেটি হলো এ দেশে মুসলমান শাসকদের বিজয়। তাদের কাছে যুদ্ধে ভারতীয় নৃপতিরা রাজ্য হারান। ভাবখানা এই যে, ভারত সে হারানো রাজ্য ফিরে পেল। পাকিস্তান তথা মুসলমানদের হারিয়ে দিলো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের মনোভাব এটাই ছিল।
কিন্তু এবারের ক্রিকেট ভারতকে জানিয়ে দিলো, তাদের প্রায় বিবস্ত্র নায়িকারা ধর্মপ্রধান ষড়যন্ত্র, কূটনামি, চক্রান্ত সিরিয়াল কোনো কিছুই বাংলাদেশের তরুণদের দেশপ্রেমে চিড় ধরাতে পরেনি। ক্রিকেটে তার সর্বশেষ প্রমাণ মিলল, যে দিন অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত শোচনীয় পরাজয় বরণ করল। সে দিন বাংলাদেশের শহরগুলো শুধু নয়, গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল এ দেশের লক্ষ কোটি মানুষ। কিন্তু একই অস্ট্রেলিয়া যখন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ অর্জন করল, তখন সে আনন্দের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ভারত যদি এই সত্য উপলব্ধি করে তাহলেই দুই দেশের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভেতরের আগুন এভাবেই জ্বলতে থাকবে।
এবার প্রসঙ্গ অস্ত্র উদ্ধার। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের ধার যখন অত্যন্ত তীব্র, সারা দেশের মানুষ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল-অবরোধে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তখন বেশ কয়েক দফায় ঘটানো হলো আরেক নাটক। শুধু এক দফায় নয়, দু-তিন দফায় সে নাটক মঞ্চস্থ করা হলো। তা হলো, মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কাছাকাছি বাংলাদেশের গহিন অরণ্য অঞ্চল থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার। বলা হলো, এই অঞ্চলে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় বাঙ্কারের মধ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব। কাকপক্ষী কেউ জানল না, কেউ কোনো দিন বলল না, সরকারেরও কোনো খবর হলো না, হঠাৎ করেই অনুগত কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিককে হেলিকপ্টারে করে সেখানে হাজির করা হলো। তারপর প্রদর্শন করা হলো নানা ধরনের বিপুল যুদ্ধাস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায়, এগুলোর বেশির ভাগই মরচে ধরা, নতুন কিছু নয়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অস্ত্র বিষয়ে যাদের ধারণা আছে, তাদের অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। এত অস্ত্রই যদি বাঙ্কারের নিচে পড়ে থাকে, তাহলে এই দীর্ঘকাল তার খবর কেন পেল না র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি-মিলিটারি।
প্রথম দফায় শুটিং করে আনা এসব অস্ত্রের প্রদর্শনী দেখল সাধারণ মানুষ। কেউ বিশ্বাস করল বলে মনে হয় না। এর কিছু দিন পর আবার একই গল্প। একটি ছোট সুড়ঙ্গপথ। সেখান দিয়ে ঢুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষ ট্রুপাররা কাঁড়ি কাঁড়ি অস্ত্র তুলে আনলেন। তার শুটিংয়ের জন্য সেখানে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হলো অনুগত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের।
এই অস্ত্র উদ্ধারের পর সরকারের মাত্রাহীন উল্লাস ছিল একেবারে তাক লাগানোর মতো। এই তথাকথিত ‘অস্ত্র উদ্ধারের’ পর সরকার শোর তোলার চেষ্টা করল যে, রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা এই অস্ত্রভাণ্ডার সেখানে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ওই এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার নাটকের প্রায় আগে থেকেই সরকার সেখানে জনসাধারণের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বিদেশী নাগরিকেরা যেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র ছাড়া ওই এলাকায় চলাচল করতে না পারে তারও ব্যবস্থা করেছিল সরকার।
এ দিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর একটি স্বাধীনতাকামী দলকে ওই অস্ত্রের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ দাবি করে আসছিল, এখনো বাংলাদেশের ভেতরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত ৩৫টি সশস্ত্র ক্যাম্প রয়েছে। সেসব ক্যাম্প থেকে নিয়মিত ওই এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নানা ধরনের সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করছে। অস্ত্র উদ্ধার নাটকের মাধ্যমে সরকার ভারতের নরেন্দ্র মোদি গভর্নমেন্টকে এই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করল যে, ভারতের দাবি অনুযায়ী সীমান্তে ওই দেশের স্বাধীনতাকামীদের অস্ত্রভাণ্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। তাতে ভারত সরকার হাসিনা সরকারের প্রতি অতিশয় প্রীত বোধ করবে।
কিন্তু দেশের ভেতরে এই বলে ঢাক পেটানো হলো যে, এসব অস্ত্র তথাকথিত ইসলামি জঙ্গিরা ওই এলাকায় রেখে দিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে তারা দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল। অর্থাৎ এর মাধ্যমে কিভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়, সে চেষ্টাই করেছে সরকার। এসব অপপ্রচার দেশের জন্য চরম অসম্মানজনক হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে যে বৈঠক হয়, তাতেও বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে আবার সাত রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের ৩৫টি ক্যাম্পের তালিকা দেয় এবং দাবি করে যে, সাত রাজ্যের মুক্তিযোদ্ধারা এসব ক্যাম্প থেকে ভারতের ভেতরে হামলা চালাচ্ছে।
বিএসএফ দাবি করে, ওই ক্যাম্পগুলো নাগাল্যান্ডের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পরিষদ (ইসাক-মুইভা), আসামের সম্মিলিত মুক্তি ফ্রন্ট (উলফা) ও ত্রিপুরার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট (এনএলএফটি) ব্যবহার করে। ক্যাম্পগুলো অবিলম্বে ধ্বংস করতে হবে।
ভারতের সাত রাজ্যের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে পঞ্চাশের দশক থেকেই। এখনো চলছে বিরতিহীনভাবে। এ ইস্যুটি সীমান্ত সমস্যা। কিন্তু দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও হরতালের মধ্যে সরকার একে জঙ্গিবাদী ইসলামি কার্যকলাপ বলে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে কেউ মনে রাখার চেষ্টা করছে না, এসব ঘটনাকে ইসলামি জঙ্গিবাদী তৎপরতা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টায় দেশের ভাবমূর্তি কী মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। আর সব কিছুর জন্যই সরকার বিএনপি ও জামায়াতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। সরকারের মূর্খ মন্ত্রীরা এমন কথা বলতে ছাড়ছেন না যে, বিএনপি-জামায়াত হলো জিহাদিদের দল, তারা হুজি সমর্থক। এবং সম্প্রতি বলছেন, এদের সাথে আইএসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসব বালখিল্য উক্তির মাধ্যমে তারা যে জাতির কত বড় ক্ষতি করছেন, সেটি বোঝার মতো বুদ্ধি তাদের আছে বলে কখনো মনে হয়নি।
কিন্তু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, অভিযুক্ত বিএনপি বা জামায়াত কোনো দলের পক্ষ থেকেই বাংলাদেশে ওই ধরনের অস্ত্রেরব্যবহার সংবলিত কোনো আক্রমণ পরিচালিত হয়নি। যেসব অস্ত্রশস্ত্র দেখানো হয়েছে, সেগুলো সাধারণ মানুষের ওপর ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। সে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম একটি ঘটনাও ঘটেনি। অথচ সরকার জঙ্গিবাদীদেরই ওই ‘বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে’র মালিক ও ব্যবহারকারী বলে উল্লেখ করছে।
২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর বিজিবি-বিএসএফের যৌথ বৈঠকে ভারতের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে বিএসএফ এমন কথাও বলে যে, ‘কিছু সন্ত্রাসী মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।’ সভাটি হয়েছিল সিলেটের তামাবিলে। তাতে যোগ দিয়েছিলেন ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম এলাকার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধানগণ। বাংলাদেশের সাথে ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম ও আসামের ১৮৮০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এ দিকে আবার অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসীরা ভারতের ভেতর হামলা চালিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে ঢের।
সিলেটের জঙ্গল থেকে যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, এসব অস্ত্রের সাহায্যে ‘ইসলামি জঙ্গি’রা বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে এর সব কিছুই পরিহাসে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা ও তারপর কোনো ঘটনাই প্রমাণ করে না যে, তথাকথিত ইসলামি জঙ্গিরা সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। ওই অস্ত্র কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে কোনো পক্ষের ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল, এমন কোনো প্রমাণ কখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু তখন সরকারি ও চাটুকার বেসরকারি মিডিয়া প্রচার করেছে যে, ওই অস্ত্র আনা হয়েছিল তথাকথিত ইসলামি জঙ্গিবাদীদের জন্য। আবার মিডিয়ার এসব প্রপাগান্ডার সূত্র ধরেই ‘টাইম’ সাময়িকী লিখেছিল, বাংলাদেশে ‘সবুজ বিপ্লব’ হয়েছে।
তবে তদন্তে দেখা যায়, ওই অস্ত্রগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হয়েছিল ভারতের আসাম রাজ্যের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। এতে মিডিয়ার মুখে যেন পচা ডিম পড়েছিল। তথাপি আওয়ামী লীগ সরকার গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক দুই প্রধানকে ওইসব অস্ত্রশস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অভিযোগে শাস্তি প্রদান করেছে। যদিও ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে তাদের চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্তের প্রায় সবটাই ইতোমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তাহলে কোন পথে ভারতের স্বাধীনতাকামীদের বাংলাদেশের আসা ও এত বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলা সম্ভব?
ভারতের সাথে সীমান্ত সংঘর্ষের দিক থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত একেবারেই মরূদ্যান বিশেষ। সেখানে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী অকারণে নিরস্ত্র, নিরীহ বাংলাদেশীদের পাখির মতো হত্যা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত দারোয়ানেরা সে দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না কিংবা নির্দেশ নেই। ফলে বাংলাদেশ ভারতীয়দের জন্য নিঃসন্দেহে হাত পাকা করার এক সীমান্ত বিশেষ। ২০১৩ সালের শেষ দিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল ও চীনের সাথে ভারতের যে আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে, সে এলাকা থেকে (চীন বাদে) ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫১৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ লাখ ১২৭ কেজি মাদকদ্রব্য ওই এলাকা থেকে আটক করা হয়। এই রিপোর্টটি তৈরি করা হয় বিএসএফের সশস্ত্র সেনাবল ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ ও আসাম রাইফেলসের তথ্যের ভিত্তিতে।
এ রিপোর্টটি তৈরি করার আগে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সীমান্ত টহলবাহিনী সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও মাদক পাচার রোধে তদারকি শুরু করে। কেন এই যৌথ টহল? কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, মিয়ানমান সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও মাদক পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ ও টহলের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দিয়েছে মিয়ানমার ২০১৩ সালের মে মাসের শেষ দিকে। তারা বিজিবির ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং এতে একজন বিজিবি সদস্য নিহত হন। উত্তেজনার চরম পর্যায়ে ২০১৩ সালের ৩১ মে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিবৃতিতে বলে, ২৮ মে ২০১৩ মিয়ানমার বাহিনীর সাথে বিজিবির যে সঙ্ঘাত বাধে, তার প্রধান কারণ ছিল তাতে দু’জন সন্দেহভাজন সশস্ত্র বাঙালি হলুদ ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরে মিয়ানমারের মংদু টাউনে ঢুকে পড়ে। তাদের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অপরজন বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। এরপর মিয়ানমান বাংলাদেশ সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করে। জবাবে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে, ‘মিয়ানমার সীমান্তে তারা যে সৈন্য মোতায়েন করেছে তা ১৯৮০ সালের চুক্তির বরখেলাপ। সুতরাং ওই সৈন্য প্রত্যাহার করা উচিত।’
মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি সহজ করে আনার জন্য উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ১০-১২ জুন। তাতে মিয়ানমারের পক্ষে ছিলেন পুলিশপ্রধান মেজর জেনারেল জ. উইন এবং বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তারা ইয়াবার চোরাচালান রোধে এবং ওই এলাকায় সশস্ত্র গ্রুপগুলো সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সম্মত হয়। ওই বৈঠকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ব্যাপারেও তথ্যবিনিময় করবে বলে সম্মত হয়। ওই পর্যন্তই। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ সরকার আরএসও বিষয়টি আরো গভীরভাবে খতিয়ে দেখবে।
যদিও মিয়ানমারের মুসলিমপ্রধান আরাকান রাজ্যকে আরএসও স্বাধীন করতে চায় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, আরএসও এ ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে কার্যত আরএসও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। কিন্তু ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত সংশ্লিষ্ট এক বাংলাদেশী কূটনীতিক গত জুনে ‘মিয়ানমার টাইমস’কে বলেছেন, বিজিবি বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে আরএসও’র কোনো তৎপরতার প্রমাণ পায়নি। অর্থাৎ এর সব কিছুর মধ্যেই একটি গোঁজামিল ও ধোঁকা রয়েছে। সব কিছুর ভেতরেই ভারতকে তুষ্ট করার ব্যাপার রয়েছে।
অথচ এর মধ্য দিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার অসহায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছাত্রদের বিরুদ্ধে সরকার নিগ্রহ অভিযান চালাচ্ছে। অভিযোগ : তারা আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঘটনাচক্র প্রমাণ করে এ অভিযোগ সত্য নয়, সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ সরকার মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অতএব করুণ পরিণতি তাদের জন্য অনিবার্য।
(‘ইয়ে কাহানি ফের সহি’-কারো আগ্রহ থাকলে ইউটিউবে গিয়ে গোলাম আলীর এ গজলটি উপভোগ করতে পারেন।)
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
reywansiddiqui@yahoo.com