জাহিদ কুরাইশি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বেঞ্চে প্রথম মুসলিম বিচারক

321
জাহিদ কুরাইশি

জাহিদ কুরাইশি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম বিচারক হিসেবে ফেডারেল বেঞ্চে নিয়োগ পেয়েছেন। নিউ জার্সির ম্যাজিস্ট্রেট কুরাইশিকে ফেডারেল বিচারক হিসেবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মনোনয়ন ১০ জুন বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের সায় পেয়েছে। কুরাইশির মনোনয়ন ৮১-১৬ ভোটে পাস হয় ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত সিনেটে। নিউ জার্সিতে তিনিই প্রথম কোনো এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, যিনি ফেডারেল কোর্টের বিচারক হলেন। প্রথম এশিয়ান-আমেরিকান হিসেবে নিউ জার্সির ফেডারেল বেঞ্চে দায়িত্ব পালন করার গৌরব অর্জন তার জন্য যথেষ্ট আনন্দের।

জাহিদ কুরাইশি যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম বিচারপতি

জাহিদ নেসার কুরাইশি। ২৪৪ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মুসলিম বিচারক। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গৃহীত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। সে সময় থেকে ধরলে আগামী ৪ জুলাই ২৪৫ বছর হবে দেশটির। জাহিদ নেসার কুরাইশির নিয়োগের মধ্য দিয়েই ২৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম মুসলমান ফেডারেল বিচারক পেল দেশটি। জাহিদ ‘ডিস্ট্রিক্ট জাজ’ থেকে ‘ফেডারেল জাজ’ হওয়ায় দেশটিতে  নতুন এই ইতিহাস রচিত হয়েছে।

জাহিদ কুরাইশির পরিচয়

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জাহিদ ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম নিউইয়র্কে হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন ফ্যানউড ও নিউজার্সিতে।

জাহিদের মা শাহিদা পি কুরাইশি। জাহিদের বাবা ড. নিসার এ কুরাইশি ১৯৭০ সালে পাকিস্তান থেকে নিউইয়র্ক যান। দেশটিতে চিকিৎসা সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানি এই অভিবাসী।

বাবা নিসার ছেলে জাহিদের এই অর্জন অল্প কিছুদিনের জন্য দেখে যেতে পারেন নি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের এপ্রিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তৃণমূল অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।

জাহিদ কুরাইশিরশিক্ষাজীবন

১৯৯৩ সালে তিনি স্কচ প্লেইনস ফ্যানউড হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।জাহিদ ১৯৯৭ সালে জন জে কলেজ অফ ক্রিমিন্যাল জাস্টিসে পড়াশোনা করেন এবং ব্যাচেলর অফ আর্টস (বিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন । ২০০০ সালে নিউ জার্সির বিখ্যাত রাটগার্টস ল স্কুল থেকে আইনে জুরিশ ডক্টর (জেডি) ডিগ্রি অর্জন করেন।

জাহিদ কুরাইশি :বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

২০১১ সালের দিকে একটি ল ফার্মে যোগ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার পর সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পান। সরকারি আইনজীবী হিসেবে তখন তার পথচলা শুরু।

জাহিদ ২০১৯ সালে নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে সেখানকার ফৌজদারি আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন ‘রিকার ড্যানজিগ শেরার হাইল্যান্ড অ্যান্ড পেরেত্তি’ ল ফার্মে।

জাহিদ ইরাক থেকে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী অ্যাটর্নি হিসেবে কাজ করেছেন। মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে অ্যাটর্নি হিসেবে কাজ করে অর্জন করেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা।

জাহিদ কাজ করেছেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের সহকারী প্রধান কাউন্সেলর হিসেবে। এ ছাড়া মার্কিন সেনাবাহিনীর (ইউএস আর্মি জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল’স কর্পস) কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলা তথা নাইন ইলেভেনের পর তিনি সামরিক প্রসিকিউটর হিসেবে দেশটির সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে তিনি ইরাকে নিযুক্ত হন। ২০০৪ ও ২০০৬ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইরাকে কাজও করেছেন। সেনাবাহিনীতে ‘ক্যাপ্টেন’ পদমর্যাদাও দেয়া হয় তাকে।

চমৎকার পাবলিক সার্ভিস ক্যারিয়ার

মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কুরাইশিকে মনোনয়নে তার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মনোনয়ন বৃহস্পতিবার অনুমোদন দেয় সিনেট। ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত সিনেটে ৪৬ বছর বয়েসী জাহিদের মনোনয়ন ৮১-১৬ ভোটে অনুমোদন পায়।

সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটিক দলের নেতা চাক শুমার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বেঞ্চে কখনোই কোনো মুসলমান বিচারক ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রে জনতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পেশার ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর সঙ্গে একমত হবেন বলে মন্তব্য করেন।

ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ডিক ডারবিন বৃহস্পতিবার এক মন্তব্যে বলেন, কুরাইশির রয়েছে চমৎকার পাবলিক সার্ভিস ক্যারিয়ার। তিনি উল্লেখ করেন যে, জাহিদ “পাকিস্তানি অভিবাসীর ছেলে”।

কুরাইশির নিয়োগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

কুরাইশির নিয়োগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে। উদ্বেগ জানিয়েছে দেশটিতে মুসলমান নাগরিকদের অধিকারবিষয়ক সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর)।  কুরাইশির পেশাজীবনের অতীত নিয়ে উদ্বেগ জানায় সিএআইআর।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে দেশটির অভিবাসন ও শুল্কবিষয়ক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর (আইস) সঙ্গে কাজ করেছেন কুরাইশি। ইরাক যুদ্ধে অবদানের জন্যও ব্যাপক সমালোচিত তিনি। ইরাকযুদ্ধে মুসলিমদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আমেরিকাতেই তুমুল আলোচনা-সমালোচনা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

সিএআইআরের সরকারি সিদ্ধান্তবিষয়ক বিভাগের পরিচালক রবার্ট ম্যাকাও বলেন, ‘বিচারক কুরাইশির অতীত কর্মজীবন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সিএআইআর। ইরাকযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল। সে সময় বন্দিদের আটকবিষয়ক আইনি পরামর্শ দিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছিলেন কুরাইশি। বুশ প্রশাসনের মেয়াদের শেষ বছরে আইসের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। যুক্ত ছিলেন অভিবাসীবিরোধী সিদ্ধান্তের সঙ্গে।’

রবার্ট ম্যাকাও আরও বলেন, ‘এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এখন না কুরাইশি নিজে কোনো কথা বলছেন, না হোয়াইট হাউস বা কংগ্রেস থেকে কিছু বলা হচ্ছে। খুব সচেতনভাবে কুরাইশির অতীত কর্মজীবন এখন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কুরাইশির প্রতি এ বিষয়গুলো নিয়ে জবাবদিহির আহ্বান জানাচ্ছে সিএআইআর। একই সঙ্গে মুসলমানসহ যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিকের অধিকারের সমতা নিশ্চিতে বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালনেরও আহ্বান জানাচ্ছি।’

তথ্যসূত্র