সরকারি নিপীড়নে জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা

13

ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সোমবার বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূলায়ন করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ‘এমিড পলিটিক্যাল কেওস, বাংলাদেশ ফিয়ারস অ্যা রাইজ ইন মিলিটেন্সি’ শিরোনামের নিবন্ধটিতে আশঙ্কা করা হয়েছে, বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর চলমান নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পারে।

নিবন্ধটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

‘বাংলাদেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর মারাত্মক সরকারি দমনপীড়ন দেশটিতে ক্ষোভ এবং ভীতি বাড়াচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এতে এখানে উগ্র জঙ্গিবাদের বীজ বপনের একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে গত জানুয়ারিতে রাজপথে নামার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত একশ’ জন লোক মারা গেছেন। পুলিশ হাজার হাজার নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং বিরোধী দলগুলোর বিক্ষোভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে রেখেছে। বিরোধীরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করায় দেশব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

বিপরীতে পুলিশ রাজনৈতিক মতকে গলাটিপে ধরা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মত পন্থা অবলম্বন করায় মানবাধিকার কর্মীরা আশংকা করছেন, এই সুযোগে উগ্রপন্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে সহনশীল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশটিতে নিপীড়িত কর্মীদের দলে ভেড়ানোর ভাল উপলক্ষ্য পেতে পারে।

নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, গণতন্ত্র যদি অবমূল্যায়িত হয় তাহলে চরমপন্থা আসকারা পেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণের খুব কমই সুযোগ আছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ বা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

জেষ্ঠ্য মন্ত্রী এবং প্রায়ই সরকারের মূখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রশাসন ‘শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক কর্মসূচির অনুমোদন দিচ্ছে তবে ‘সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে’ বাধা দিচ্ছে।

দেশটির পুলিশ প্রধান (ইন্সপেক্টর জেনারেল) শহীদুল হক বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো শুধু নিজেদের রক্ষায় গুলি করে থাকে।

অন্যদিকে, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার সব দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এখানকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ইসলামী দলগুলো রাজনৈতিক পন্থা বাদ দিয়ে এই দেশের ‘তালেবান’ হয়ে উঠতে পারে। দেশের বাইরের জঙ্গি গ্রুপগুলো এই অস্থিরতার সুযোগ নিতে পারে বলেও তার আশংকা।

বিগত সপ্তাহগুলোতে পুলিশ একাধিক বার বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধারসহ অনেককে আটক করে দাবি করেছে তারা জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সাথে সংশ্লিষ্ট।

এই জঙ্গি গ্রুপটি ২০০২ সালে বিভিন্ন আদালত, সিনেমা হল এবং শপিং মলে বোমা হামলার জন্য দায়ী।

সম্প্রতি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের একটি প্রদেশে বোমা বানানোর সময় জেএমবির সাতজন সদস্যকে আটকের পর নিরাপত্তা বাহিনীর ধারণা, গ্রুপটি আবারো যে কোনো সময় স্বমূর্তিতে ফিরে আসতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল হচ্ছে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মারাত্মকভাবে বিতর্কিত পুনঃনির্বাচন।

নির্বাচনের সময়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়া সংক্রান্ত সংবিধানের একটি অধ্যায় শেখ হাসিনা বাতিল করে দেন। এর প্রেক্ষিতে হাসিনার বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিকতার অভিযোগ এনে বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে। এরপর থেকে বিরোধী বিভিন্ন পক্ষ তার পদত্যাগ এবং দ্রুত নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আর তার সহযোগীরা দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত বিএনপিকে দাবি আদায়ে দেশব্যাপী সব পথে অবরোধ দেয়ার কারণে জঙ্গি গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর সাথে তুলনা করে থাকেন।

সংকটের এই পর্যায়ে চলতি মাসেই বিএনপির মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন আহমেদকে অস্ত্রধারীরা তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের দাবি অনুযায়ী, অস্ত্রধারীরা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোক। এর পর তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ স্বামীর সন্ধান চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করলেও পুলিশ আদালতের কাছে এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।

হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘আমরা খুব ভয়ের মধ্যে আছি। তাকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে এবং শারিরীকভাকে ক্ষতি করা হতে পারে।’

সরকার সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে বললেও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে কাউকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নিহত বা কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ হিসেবে গণ্য হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ওয়াদুদ বেপারি নামে ৩০ বছরের এক শ্রমঅধিকার কর্মী এবং বিএনপি নেতা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন। তার বাবা আবদুল আলী বেপারী মধ্যরাতে তার কাছে ছেলের মৃত্যুসংবাদের খবর আসার কথা স্বরণ করে বলেন, অজ্ঞাত একজন মাঝরাতে ফোন করে বলল ‘মর্গে এসে ছেলের লাশ নিয়ে যান। এরপরই ফোনের লাইন কেটে গেল।’

পুলিশ বলছে, ওয়াদুদ বেপারিকে গত মাসে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে’ জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়। এরপর তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিরোধী নেতাকর্মীদের সাথে এক ‘ক্রসফায়ার’র ঘটনায় তিনি মারা যান। সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওয়াদুদের বুকে এবং পিঠে অন্তত ছয়টি গুলির চিহৃ ছিল।

ওয়াদুদের বাবা জানান, তিনি পুলিশের বক্তব্য বিশ্বাস করেন না। তার ছেলে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ছে ওয়াদুদের মতো ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতের ঘটনা বাংলাদেশে এখন প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অনুসন্ধান বিভাগের পরিচালক নূর খান বলেন, ‘ক্রসফায়ার, একাউন্টার অথবা অন্য যে নামেই ডাকা হোক এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

আবুল বাশার (৩২) নামে জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মী জানান, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি তার বাড়িতে রাত কাটাতে পারেন না এই ভয়ে যে, পুলিশ যদি তাকে আটক করে তাহলে মেরে ফেলবে।

পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের সন্দেহে তাকে পুলিশ খুজেঁ বেড়ালেও এ ধরনের কোনো হামলায় তার জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বাশার বলেন, ওই ঘটনা যখন তার গ্রামে ঘটে তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন।  তিনি বলেন, আমাদের জন্য কোনো আইন নেই, কোনো নিরাপত্তা নেই।

বাশারের নিজেরও ধারণা, যদি তাদের আন্দোলন এখনো ‘শান্তিপূর্ণ’ আছে, কিন্তু তার ভয় হচ্ছে অনেক কর্মী আস্তে আস্তে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়ে উগ্রপন্থায় ঝুকেঁ যেতে পারেন। তিনি বলেন, লোকজন তাদের বন্ধু, ভাইদের হারিয়ে ফেলেছে। তাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা বেপোরায়া হয়ে উঠছে। (সংক্ষেপিত)