প্রমীলা-প্যাঁচে নাজেহাল মোদি

30

বছর ঘুরতে না ঘুরতে এই রকম প্রমীলা-প্যাঁচে তিনি যে ঘায়েল হবেন, নরেন্দ্র মোদি নিশ্চিতই তা কল্পনাও করেননি। ভারতের এই গৃহী-সন্ন্যাসী প্রধানমন্ত্রীর নারীভাগ্য খারাপ মনে হচ্ছে। নইলে নারী-নাগপাশে তাঁকে এভাবে জর্জরিত হতে হবে কেন?
বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া যাক। যশোদাবেনকে তিনি কেন বিয়ে করেছিলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা মোদি আজ পর্যন্ত দেননি। বিয়ে করলেনই যদি, বিবাহিত জীবনযাপন না করে কেনই বা তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হতে গিয়েছিলেন, সেই কারণও স্পষ্টত কেউ জানে না। অবশ্য, প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার না হওয়া পর্যন্ত মোদি যে দার পরিগ্রহ করেছিলেন, সেটাও অধিকাংশের অজানা ছিল। জানাজানি হলো নির্বাচন কমিশনের দাবি মেনে হলফনামা দাখিল করতে গিয়ে। সে নিয়ে ওই সময় চাপা ও প্রকাশ্য ফিসফাস যে হয়নি, তা নয়। নরেন্দ্র মোদি অবশ্য সেসব গায়ে মাখেননি। বিজেপিও বিষয়টি নিতান্তই ব্যক্তিগত বলে জাহির করেছিল। জনতা মেনেও নিয়েছিল তা। আর যাই হোক, ব্যক্তিগত দিক নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে ভারতীয় মূল্যবোধে এখনো বাধো বাধো ঠেকে। তাই প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী কেন ৭ রেসকোর্স রোডের বাসিন্দা নন, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা পানাপুকুরে দু-এক দিন বুদ্বুদ কেটে মিলিয়ে যায়।
তাঁকে নিয়ে দ্বিতীয় বিতর্ক কিন্তু যশোদাবেনেরই তোলা। ইন্দিরা গান্ধী নিজের রক্ষীদের গুলিতে মারা যাওয়ার পর ভারতীয় নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপের (এসপিজি) জন্মও তখন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষা এই এসপিজিরই দায়িত্ব। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এসপিজির নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে যশোদাবেনও ঢুকে পড়েন। আর সেই থেকে শুরু তাঁর উসখুসানি। তাঁর বাড়ির চারধারে নিরাপত্তা। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, নিরাপদ দূরত্বে থেকেও প্রহরীরা তাঁকে ঘিরে থাকছে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে যশোদাবেন আপত্তি জানান। যদিও তাতে কাজ হয়নি।
স্ত্রী সম্পর্কে একটি শব্দও আজ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির মুখ থেকে কেউ কখনো শোনেনি। সেটা না হয় ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু চার-চারজন নারীর নাগপাশে এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েও তিনি কেন স্পিকটি নট, দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তা মেনে নিতে পারছে না। প্রশ্ন তাই নিত্যদিন উঠেই চলেছে। এবং নিত্যদিন ধেয়ে আসছে আক্রমণের এক একটি নতুন ফলা।
বিস্ময়ের যা, বর্ষপূর্তির পরপরই ঝুপঝুপ করে যে চার বিতর্ক মোদি-মাহাত্ম্যের প্রতি প্রশ্ন তুলে দিল, তার প্রতিটির কেন্দ্রেই রয়েছেন একজন নারী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে যাঁর হয়ে উমেদারি করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন, তিনিও অন্য এক মোদি। ললিত মোদি। রাজস্থানের এই ক্ষুরধার বুদ্ধির ব্যবসায়ী ক্রিকেটকে এক ভিন্ন মোড়কে বিপণন করে গোটা পৃথিবীতে হইহল্লা ফেলে দিয়ে নিজেই এমন জাঁতাকলে পড়ে গিয়েছেন যে আপাতত দেশছাড়া হয়ে বিলেতে পড়ে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা একগাদা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে ভারতীয় অর্থমন্ত্রকের গোয়েন্দারা। এই রকম এক অপরাধীর ভিসার জন্য সুষমা ও বসুন্ধরার উদ্যোগ নীতিগত হাজারটা প্রশ্ন তুলেছে। সুষমার স্বামী স্বরাজ কৌশল এবং কন্যা বাঁশরি আবার ললিত মোদির আইনি পরামর্শদাতা। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে স্বার্থের আদান-প্রদান থাকার অভিযোগ বিরোধীরা তুলেছে। অভিযোগগুলো যে নিতান্তই মনগড়া, এমন কথা বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারছে না। অথচ সুষমা তো বটেই, নরেন্দ্র মোদিরও মুখে কুলুপ। এত দিন হয়ে গেল, একটা বাক্যও কেউ খরচ করলেন না।
বসুন্ধরার ব্যাপারটি সুষমার মতো অত সহজ-সরল নয়। তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা নতুন তথ্য উঠে আসছে। যেমন ললিতের সঙ্গে সুষমা ও তাঁর পুত্র দুষ্মন্তর ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার বিষয়টি। ললিতকে নানাভাবে সাহায্য করার প্রতিদানে ললিতও নাকি তাঁদের ঢেলে দিয়েছেন। যেমন দুষ্মন্তর হোটেল ‘নিয়ন্ত’-এর দশ রুপি দামের শেয়ার তিনি ৯৬ হাজারেরও বেশি দামে কিনে প্রায় ৩১ কোটি রুপি পাইয়ে দিয়েছেন। আবার নতুন যে অভিযোগ কংগ্রেস তুলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্থানের ঢোলপুর রাজপ্রাসাদ (এই ঢোলপুরের রাজা হেমন্ত সিংয়ের সঙ্গে ১৯৭২ সালে বসুন্ধরার বিয়ে হয়, পরের বছর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ছাড়াছাড়ি), যা নাকি বহু বছর আগে থেকেই সরকারি সম্পত্তি, বসুন্ধরা ও দুষ্মন্ত তা হাতিয়ে নিয়ে সেখানেই ‘নিয়ন্ত’ হোটেল খুলেছেন, ললিত যেখানে টাকা ঢেলেছেন। অর্থাৎ বিতর্কটা হলো একজন পালিয়ে বেড়ানো অর্থনৈতিক অপরাধীকে মোদির সরকার ও দলের দুই শীর্ষ নেত্রী নানাভাবে সাহায্য করছেন ও বিনিময়ে সাহায্য পাচ্ছেন অথচ প্রধানমন্ত্রী রা কাড়ছেন না।
সুষমা ও বসুন্ধরা যদি সাঁড়াশি আক্রমণের জোড়া ফলা হন, স্মৃতি ইরানি ও পঙ্কজা মুন্ডে তাহলে আরও দুই বিব্রতকর ক্ষেপণাস্ত্র।

আর যাই হোক, নরেন্দ্র মোদির রথ প্রথম বছরের মতোই গড়গড় করে এগিয়ে চলবে, তেমন আশা বিজেপিরও কেউ করছে না

স্মৃতি ইরানি একেবারে শুরু থেকেই মোদির স্নেহভাজন। বিশাল শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মোদি তাঁকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পূর্ণ দায়িত্বে বসিয়েছেন। এ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের শুরু থেকেই অনেকের ভ্রু কুঁচকে ছিল। কিন্তু ভোটে বিপুল জয় মোদিকে এতটাই ক্ষমতাধর ও আস্থাবান করে তোলে যে কেউই ফুট কাটতে পারেনি। স্নেহভাজন স্মৃতির নির্বাচনী হলফনামা মোদির তৃতীয় বিড়ম্বনা। ললিত-কাণ্ডের মতো ব্যাপারটা নিয়ে তেমন হইচই না হওয়ার কারণ একটাই। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। দিল্লির মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি বিচারযোগ্য বলে গ্রহণ করেছেন। স্মৃতি মোট তিনবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে দুটি তথ্য তিনি দাখিল করেছেন। সেই তথ্যের একটি ঠিক হলে অন্যটি ভুল। অতএব এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত, স্মৃতি একটি ক্ষেত্রে অসত্য তথ্য জমা দিয়েছেন। এখন আদালত কী রায় দেবে সেদিকেই সবার দৃষ্টি। তবে আইন ও নীতির দৃষ্টি সব সময়ই আলাদা। মোদি বারবার নৈতিকতার প্রশ্ন তোলেন। সেই নিরিখে সব বিষয়ে চুপ থেকে তিনি কিন্তু নৈতিকতার বিরোধিতাই করছেন।
পঙ্কজা মুন্ডে রাজনীতিতে সদ্যোজাত। তাঁর বাবা গোপীনাথ মুন্ডে মহারাষ্ট্র বিজেপির একেবারে প্রথম সারির প্রধান নেতা ছিলেন। ভোটের পরপরই দিল্লিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর অকালমৃত্যু হয়। পঙ্কজা রাজনীতিতে এসেই নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্কের কেন্দ্রে। বিভিন্ন জিনিস কিনতে মোট ২০৬ কোটি রুপির অর্ডার তিনি দেন বিনা টেন্ডারে। বিরোধীরা এ থেকেই দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছে। রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। চাপ বাড়ছে মোদির ওপরেও। কিন্তু তিনি মূক ও বধির ক্লাবের সদস্য সেজে রয়েছেন।
অথচ এই মোদিই লোকসভা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনসভায় বড় মুখ করে বলেছিলেন, ‘না ম্যায় খায়ুঙ্গা, না কিসিকো খানে দুঙ্গা।’ গোদা বাংলায়, না আমি ঘুষ খাব, না কাউকে খেতে দেব। সহজ মানে, নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত হব না, কাউকে দুর্নীতি করতেও দেব না। কংগ্রেসের শেষ তিন বছরের দুর্নীতিতে জেরবার মানুষ মোদির মধ্যে আস্থা ও ভরসার একটা ঝিলিক দেখতে পেয়েছিল। প্রথম বছরটা সেই ভরসায় গা ভাসিয়ে সরকার দিব্যি কাটিয়েছে। কিন্তু বছর গড়াতে না গড়াতে একই সঙ্গে এই চার নারী-সৃষ্ট বিতর্ক মোদির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে। বিরোধীরা ঘা মারছে সেখানেই। মোদির নৈতিকতার ফানুসে পিন ফুটিয়ে কংগ্রেসও চাইছে পাল তুলে তার নৌকায় গতি আনতে। বলতে দ্বিধা নেই, চার নারী নরেন্দ্র মোদির প্রথম রাজনৈতিক সংকটকে আবাহনই শুধু করেননি, হতোদ্যম কংগ্রেসকেও কোরামিন জুগিয়েছেন।
ভারতীয় সংসদের বাদল অধিবেশনের আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই। বিজেপি যতই ভাবুক, এই সময়ের মধ্যে এই বিতর্ক না মেটার সম্ভাবনাই বেশি। অন্তত কংগ্রেস তা হতে দেবে না। কাজেই বাদল অধিবেশনও যে মোদি ভালয় ভালয় কাটাতে পারবেন, তেমন মনে করার কারণ নেই। অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় একাধিক বিল এখনো পাস হওয়া বাকি। ঘাড়ের ওপর ডেমোক্লিসের খাঁড়ার মতো ঝুলে রয়েছে জমি বিলও। অন্য বিলে যা-ই হোক না কেন, জমি বিল পাস করাতে হলে শেষ পর্যন্ত সরকারকে সংসদের যুগ্ম অধিবেশনই ডাকতে হবে। আমেরিকায় গিয়ে তেমনই ইঙ্গিত দিয়ে এসেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তেমন হলে সেটাও হবে এই সরকারের আরও একটা নৈতিক পরাজয়। তা ছাড়া জবরদস্তি পাস করালেও রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীরা যে জমি অধিগ্রহণ করাতে দেবে, তেমন মনে করার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ আর যাই হোক, নরেন্দ্র মোদির রথ প্রথম বছরের মতোই গড়গড় করে এগিয়ে চলবে, তেমন আশা বিজেপিরও কেউ করছে না।
লোকসভার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা মোদির সামনে তেমন চ্যালেঞ্জ খাড়া করবে না। মোদির চ্যালেঞ্জ অন্যত্র। বিহারে লালু প্রসাদ-নীতিশ কুমার হাত মিলিয়েছেন। সঙ্গে সুগ্রীব দোসর হিসেবে রয়েছে কংগ্রেস। এই বছরের শেষাশেষি নির্বাচনে বিহার যদি বিজেপিকে কোল পেতে না দেয়, পরের বছর উত্তর প্রদেশ তাহলে হয়ে দাঁড়াবে বড় কঠিন ঠাঁই। দিল্লির ভরাডুবির পর বিহার জয় মোদি-মাহাত্ম্যকে ভাসিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু তা না হলে মোদির পক্ষে ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়।’
সংসদের আঙিনায় প্রমীলা-প্যাঁচের মোকাবিলা মোদি কীভাবে করেন, আপাতত নজর থাকছে সেদিকেই। সূত্র,প্রথম আলো