গুরবা কুশতান শব-ই-আউওয়াল বা বিড়াল মারো প্রথম রাতে

আকবর আলি খানের “” বইয়ের তৃতীয় নিবন্ধের নাম “সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি”

আকবর আলি খানের “পরার্থপরতার অর্থনীতি” বইয়ের তৃতীয় নিবন্ধের নাম “সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি”। আজ এই নিবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলোচনা করছি ।
সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে কোনো সংস্কার ঢাকঢোল পিটিয়ে, হইচই করে করার বিপক্ষে মত দিয়েছেন লেখক। এক রসিক লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে এবং বৈসাদৃশ্যপূর্ণ একটি উদাহরণ টেনে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।

রসিক ব্যক্তির ভাষ্য মতে, “যারা ব্যাভিচার করে তারা কখনো এ সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না, যারা পারে না তারাই এ নিয়ে ফরফর করে। যারা সংস্কার করে তারাও এ সম্পর্কে বড়াই করে না, যারা সংস্কার করতে পারে না তারাই এ সম্পর্কে হইচই করে”।

পতিত অবস্থা থেকে মুক্তির/উত্তরণের নামই হচ্ছে- সংস্কার । সময়ের সাথে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয় না, সেখানেই অধঃপতন দেখা দেয় । এজন্যই দার্শনিক এডমুন্ড বার্ক বলেছেন, “যে রাষ্ট্রে কোনো পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেই তার সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই”।

রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্র কাঠামোতে এই পরিবর্তন অনিবার্য হলেও তাকে বিভিন্নভাবে থামিয়ে রাখা হয় । প্রথমত, রাজনীতিবিদরা নতুন কোনো ধারণা সহজে গ্রহণ করতে চান না। অন্যদিকে- কায়েমী স্বার্থবাদীরা, যারা অর্থনীতিবিদ অলসনের ভাষায় বন্টনমূলক জোট (distributional coalition) নামে পরিচিত, তারাও নানামুখী স্বার্থের কারণে এই পরিবর্তন থামিয়ে রাখে। এই স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে শিল্পপতি ও ব্যবসায়িক জোট, পেশাদারদের সমিতি এবং কর্মচারি ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন। যে কোনো সংস্কারের কথা উঠলেই কোনো না কোনো বন্টনমূলক জোটের স্বার্থ হুমকিতে পরে এবং তারা সর্বোচ্চ হিংস্রতা নিয়ে সেই সংস্কারকে থামিয়ে দেয়।
সেজন্য শুধু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করলেই হবে না। এজন্য দরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার । রাজনীতিবিদদের পক্ষে সংস্কার সম্ভব নয় কারণ তাদের চিন্তা-পরিকল্পনা থাকে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ।

সংস্কারের জন্য প্রয়োজন এমন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক যিনি অভ্যস্ত হবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা করতে। তবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্যের কোনো অব্যর্থ দাওয়াই নেই । বহুদিনের গড়ে উঠা অনাচার ও অব্যস্থাপনা রাতারাতি পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। সেজন্য, সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করে নিঃস্বার্থ রাষ্ট্রনায়কদের এগিয়ে যেতে হবে কোনো রকমের চাওয়া পাওয়ার হিসেব না কষে।

অর্থনীতিবিদ আর্নল্ড সি হারবারগার এই ধরনের নেতৃত্বকে আখ্যায়িত করেছেন “অর্থনৈতিক নীতিবীর” (economic policy heroes) হিসেবে। এই নেতৃত্বকে বিশ্বাস রাখতে হবে, সংস্কারের ক্ষেত্রে যারা বীজ বপন করে তারা সব সময়ে ফলভোগ করতে পারে না ।

সংস্কারের কৌশল দুইটি ভিন্ন পন্থায় এগুতে পারে বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রথমত “প্রচণ্ড আঘাত পন্থা”, যেখানে সকল সংস্কার একই সঙ্গে এবং সল্পতম সময়ে সম্পন্নের প্রেরনা কিংবা তাগিদ থাকে । অন্যদিকে “ধীর পন্থীরা” সংস্কারকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধীরে ধীরে সংস্কারের সাফল্য অর্জনের পক্ষে । লেখকের মতে এই প্রচণ্ড আঘাতপন্থী ও ধীরপন্থীদের বিতর্ক বিভ্রান্তিমূলক।

তিনি মনে করেন, সংস্কারের মূল সমস্যা হলো- কোন সংস্কার আগে এবং কোনটি পরে করা হবে এই পরস্পরা (sequence) নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে কেউ কেউ সহজ সংস্কারগুলো (কৌশলগত ছিটমহল- strategic enclave)  আগে করার পক্ষে। আবার কেউ কেউ যে খাতে সংস্কার করলে বেশি লাভ হবে (সম্ভবশ্রেষ্ঠ পরস্পরাভিত্তিক-optimum sequencing) সে সংস্কারগুলো আগে করতে চান । তবে, এই পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার ও কৌশল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক শক্তি ও কাঠামোর ওপর অনেকটাই নির্ভর করে ।

সংস্কারের শত্রুর অভাব নেই। সংস্কারের সাফল্য সবসময় সুনিশ্চিত না হওয়ায় অনেকেই অন্তিম সাফল্য প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত সংস্কারের সমর্থন করেন না । তাছাড়া রয়েছে স্বার্থবাদী বন্টনমূলক জোটের বাধা। এই সমস্ত বিবেচনায় সংস্কারকে তাই যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন লেখক। যুদ্ধের রননায়কদের যেমন অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনার সাথে সাথে আপৎকালীন পরিকল্পনা রাখতে হয়, তেমনিভাবে সাফল্য চিন্তার পাশাপাশি ব্যর্থতার জন্যও সতর্ক থাকা উচিত সংস্কারবাদীদের ।

লেখক মনে করেন সংস্কার প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের মতো জটিল। কেননা, প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক যে কোনো আহাম্মকও শুরু করতে পারে, কিন্তু সম্পর্কের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি টানতে পারে একমাত্র পাকা খেলোয়ার। যারা সংস্কার করে, তারা বাঘের পিঠে চড়ে বসে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে সংস্কারের পথ শ্বাপদ-সঙ্কুলে ভরা। এখানে স্বার্থবাদী বন্টনমূলক জোটগুলো বাঘের চেয়েও হিংস্র ও ক্ষিপ্র। এই সমস্ত বাঘ এড়িয়ে সংস্কার করা যায় না, আবার সব বাঘের সাথে এক সাথে লড়াইয়ের প্রয়োজনও নেই।

সেজন্য সংস্কারককে প্রথমে এমন কাজ বেছে নিতে হবে যেটি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা যাবে। শুরুতে ব্যর্থ হলে পরের লড়াইগুলো আরো কঠিন হয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে কিছুটা কৌতুকপরায়ন হয়ে পারস্যের বিখ্যাত প্রবাদ “গুরবা কুশতান শব-ই-আউওয়াল” (বিড়াল মারো প্রথম রাতে) এর কথা মনে করিয়ে নিবন্ধ শেষ করেন।