রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কি সত্যিই রাসুলের বংশধর?

212
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কি সত্যিই রাসুলের বংশধর?

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর ছিলেন বলে একটি থিওরি প্রচলিত। ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম এই থিওরিটি প্রকাশ করেন আমেরিকার সাবেক অ্যাটর্নি সিলাস বাকেরের ছেলে হ্যারল্ড ব্রুকস বাকের। হ্যারল্ড ব্রুকস বাকের নিজেকে একজন জিনিওলজিস্ট হিশেবে দাবি করলেও একাডেমিয়ায় তিনি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন।
২০০৫ সালে তার মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তার পরিচয় উল্লেখ করেছে এভাবে ‘serious, scandalous or merely ridiculous — of the British royal family’।

তার গবেষণাকে ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলি পাত্তা দেয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর হিশেবে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কেউ গর্ব করেছেন বলে এখনো জানা যায়নি। কিন্তু, হ্যারল্ড ব্রুকস বাকেরের থিওরিটি লুফে নেয় মুসলিমরা। মুসলিমরা প্রচার করতে থাকে- রাণী তো আমাদের নবীর বংশধর!

হ্যারল্ড ব্রুকস বাকের দেখান রাসূলের বংশধর স্পেনে (আন্দালুস) ছিলো, সেভিলের রাজা আল-মুতামিদের মেয়ে ছিলেন জাইদা। স্পেনে যখন ইনজুইজেশন শুরু হয়, তখন জাইদাকে দাসী হিশেবে গ্রহণ করেন স্পেনের রাজা আলফানসো ষষ্ঠ। প্রচলিত থিওরি অনুযায়ী রাজা আলফানসো ষষ্ঠ এবং জাইদার বংশধর রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

সেভিলের রাজকুমারী জাইদা থেকে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্লাড লাইন পর্যন্ত দুটো বড়ো সমস্যা আছে।
প্রথম সমস্যা হলো, জাইদা কি সেভিলের রাজা আল-মুতামিদের মেয়ে ছিলেন নাকি পুত্রবধূ? এটা নিয়ে অনেক বড়ো বিতর্ক। ঐতিহাসিক কারো মতে পুত্রবধূ, কারো মতে মেয়ে। যদি জাইদা পুত্রবধূ হন, তাহলে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পর্যন্ত তার ব্লাড লাইন দেখানো গেলেও সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিশবে না।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডকে নিয়ে। তার পরবর্তী বংশধররা মূলত ইংরেজ রাজ বংশ। কিন্তু, তিনি নিজে রিচার্ড অব ইয়র্কের আসল পুত্র কিনা এই নিয়ে বিস্তর বিতর্ক।
এই দুটো ডিফিসিয়েন্সির একটি সত্য হলেই রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর নয় বলেই প্রমাণিত হবে।

বংশবিদ্যার বিশেষজ্ঞগণ এসব ডিফিসিয়েন্সি পেলে সেটাকে ‘দাবি’ পর্যন্ত নিয়ে যান না। এটাকে সর্বোচ্চ ‘প্রবাবিলিটি’ বলা যায়। এরকম বড়ো দুটো ডিফেক্ট থাকা ব্লাডলাইনের প্রভাবিলিটি কখনোই ৫০/৫০ হবে না। সম্ভাবনা ২০/৮০ হতে পারে।

দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা এটা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কয়েকজন আলেমের ইন্টার্ভিউ নেয়া হয়। তারা এই বিষয়ে স্কেপ্টিকাল ছিলেন (স্বীকার করেননি, অস্বীকারও করেননি)।
“বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে, শোলাকিয়া ইদগাহ-এর গ্র্যান্ড ইমাম, ইকরা বাংলাদেশের প্রিন্সিপাল মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, বংশগতভাবে তিনি নবী কারিম সা. এর বংশের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমরা এ বিষয়ে গবেষকদের আলোচিত বংশধারা যাচাই করে বুঝতে পারবো বিষয়ের সত্যতা কতটুকু। রানীর বংশ জার্মান থেকে এসেছে। রাসুলের বংশের সঙ্গে মিললে আশ্চর্যের কিছু না। আর যায়দা বিবির কথা বলা হয়েছে তিনি কী আসলেই ইসলাম ধর্মের থেকে খ্রিষ্টধর্মে গিয়েছেন কী না আমরা ইতিহাস থেকে যাচাই করেই বলতে পারবো।

রাজধানী ঢাকার জামিয়া শায়খ জাকারিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক গবেষক, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ইউরোপিয় গবেষকরা ইতিহাস ঘেটে বের করেছে রানী এলিজাবেথ রাসুল সা. এর বংশের। হ্যাঁ এমন হতে পারে অস্বাভাবিক কিছুই না। তবে আমরা বিষয়টা পর্যলোচনা না করে কিছু বলতে পারছি না। ইতিহাস অনেক বড় বিষয় এটা নিয়ে পাঠ প্রয়োজন।”

সাধারণত দেখা যায় উপমহাদেশে অনেক ভূয়া সৈয়দ দাবিদার আছেন, যারা নিজেদেরকে নবিজীর বংশধর হিশেবে দাবি করেন। তবে, রাণী এলিজাবেথের ক্ষেত্রে বিষয়টা হয়েছে উল্টো।

প্রথমে একজন আমেরিকান ‘প্রোপাগাণ্ডিস্ট’ তাকে নবিজীর বংশধর বলে দাবি করেন, পরবর্তীতে মুসলিমরা সেটা ফলাও করে প্রচার করে! এমনকি মিসরের সাবেক গ্র‍্যান্ড মুফতি আলী গোমা, মরক্কোর আলেম আবদুল হামদ আল-আউউনি ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ নবিজীর বংশধর হবার প্রপাগাণ্ডাটির সাথে একমত পোষণ করেন!

পাশ্চাত্যের মিডিয়া বেশ অবাক হয় মুসলিমদের এমন আচরণে। তারা জানতে চায় কেনো মুসলিমরা এই তথ্যটি প্রচার করছে?

অনুসন্ধানের পর তারা নিশ্চিত হয়, এটার কারণ মুসলিমদের ইনফিরিওরিটি ক্রাইসিস (আত্মপরিচয়ের সংকট), নিরাপত্তার উদ্বিগ্নতা। পাশ্চাত্যের মুসলিমরা ভেবেছিলো তারা যদি দেখাতে পারে ‘রাণী আমাদের নবীর বংশের’, তাহলে হয়তো রাণীর পরিবার মুসলিমদের প্রতি উদারতা দেখাবে, মুসলিমদের উগ্র বলবে না ইত্যাদি। অথচ ইংল্যান্ড রাজ পরিবার থেকে কখনোই এই দাবি মেনে নেবার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি, তারা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
..
প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা মনে পড়লো। ইমাম আশ-শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারভুক্ত; তিনি ছিলেন হাশেমী।
তাঁকে একবার শিয়া অভিযোগে গ্রেফতার করে বাগদাদ নিয়ে যাওয়া হয়। খলিফা তখন হারুন-অর-রশীদ। তাঁর সাথে আরো ৯ জন ছিলো। বাকিদের হত্যা করা হয়।
ইমাম শাফেয়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেলে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। তিনি হারুন-অর-রশীদকে বুঝান, তাঁর বংশ এবং খলিফার বংশ একই বংশ। তিনি কিভাবে ‘আলাভী’দের সঙ্গ দিবেন?
ইমাম শাফেয়ীর পক্ষে সুপারিশ করেন ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানী রাহিমাহুল্লাহ। ফলে, ইমাম শাফেয়ী ফাঁসির রায় থেকে মুক্তি পান, খলিফার অতিথি হিশেবে গবেষণার সুযোগ লাভ করেন ইমাম মুহাম্মদের সাথে।
..
ব্রিটেনের রাণী নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর কি-না এটা তার পরকালের জীবনে কোনো কাজে আসবে না। তিনি অমুসলিম হিশেবে জীবনযাপন করেছেন, অমুসলিম হিশেবেই ইন্তেকাল করেছেন (যতোদূর জানা যায়)। ফলে, নিশ্চিতভাবে তিনি নবিজীর বংশধর হলেও এটা তার পরকালে কোনো কাজে আসবে না। আর ইহকালে তার এই পরিচয় মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে কোনো কাজে আসেনি, আসার সম্ভাবনাও নেই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আপন মেয়ে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ফাতিমা! আমার ধন-সম্পদ থেকে যা ইচ্ছে চেয়ে নাও। আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে আমি তোমার কোনো উপকারে আসতে পারবো না।”

কোনো মুসলিম যদি সত্যি সত্যিই আল্লাহর রাসূলের বংশধর হন, এই পরিচয় তাকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পেতে গেলে তাকে নেক আমল করতে হবে, গুনাহ ত্যাগ করতে হবে।

সেখানে একজন অমুসলিম নবিজীর বংশধর কি-না এই পরিচয় তার কোনো উপকারে আসবে না৷ নবিজীর পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও আবু তালিব জাহান্নামে থাকবেন। নবিজীর পরিবারের না হয়েও ঐ আফ্রিকার এক মা-বাবার সন্তান বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জান্নাতে থাকবেন।
—-
৯ সেপ্টেম্বর ২০২২


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here