জ্বরমুক্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক

46
জ্বরমুক্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক

সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাক্সেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ) এর প্রশিক্ষণ চলাকালে একজন প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক বলছিলেন টিচার্স গাইড স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতিউত্তরে প্রকল্প পরামর্শক সেলিনা পারভীন বলছিলেন, এটা হলো ইশারায় কাফিয়া। বাকিটুকুর জন্য আপনাদের সরকার নিয়োগ দিয়েছেন। আমি সেকায়েপ-এর কৌশলগত প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে ময়মনসিংহ বিভাগের সর্ববৃহত্তম জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন গণিত শিক্ষক বলছিলেন গণিত নিজেই একটি সৃজনশীল বিষয় গণিতে আবার কিসের সৃজনশীলতা?

নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের মতো অধ্যক্ষ জহুরা বেগমও বললেন নতুন শিক্ষাক্রম খুবই ভালো। তবে পরামর্শ হলো মূল্যায়ণ কাজটি কিভাবে আরো সহজ করা যায় সেটি চেষ্টা করতে হবে। (তথ্যসূত্র: অন্যরকম পরীক্ষায় শিক্ষার্থী, প্রথম আলো; ১৪ই নভেম্বর ২০২৩)

একবার প্রথম শ্রেণির শিশুদেরকে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা হবে জানানো হলো। পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় একটি শিশুর জ্বর হয় এবং ধীরে ধীরে গুরুতর অসুস্থ হতে থাকে। নির্দিষ্ট দিনে ক্লাসে বর্ণমালা লেখানোর মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। শিশুটি তখনও জানে না পরীক্ষা কেমন। পরীক্ষার শেষে উক্ত শিক্ষার্থী টিচারের কাছে জানতে চেয়েছিল পরীক্ষা কখন? টিচার জানান- তোমাদের বর্ণমালা লিখতে দিলাম সেটিই হলো পরীক্ষা। স্যার পরীক্ষা এত সহজ আগে কেন বলেননি?
রয়ীছা আল্-ইসলাম নড়াইল জেলাধীন লোহাগড়া উপজেলার অন্তর্গত এসএইচবিআর আলিম মাদ্রাসার ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সেপ্টেম্বর মাস থেকেই আত্মীয় বাড়ি যাওয়া, পারিবারিক কাজ বা অনুষ্ঠান, খেলাধোলা বন্ধ করেছে। কারণ সে নভেম্বর মাসের প্রান্তিক মূলায়ণের পড়াশোনার জন্য চিন্তিত ছিল।
কিন্তু মূল্যায়ণ শুরু হলে তার দুঃশ্চিন্তা দূর হয়ে গেছে। আনন্দের সাথে মূল্যায়ণে (পরীক্ষায়), পারিবারিক কাজ বা আড্ডায় অংশগ্রহন করছে, খেলাধুলাও করছে।

দীর্ঘদিন পরে এদেশে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে পাটিগণিতের বদলে সম্পূর্ণ বীজগণিত, মুখস্ত নির্ভর ইংরেজির পরিবর্তে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি। তারপর ফলাফল বিভাগ পদ্ধতির পরিবর্তে জিপিএ পদ্ধতি ২০০১ সালে। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি থেকে শুরু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। যেটিকে বলা হচ্ছে পরীক্ষার পরিবর্তে মুল্যায়ণ ভিত্তিক শিক্ষাক্রম যার ফলাফল প্রকাশিত হবে ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ বা বৃত্তের মাধ্যমে।

শুনেছি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রেখে যায়। তাদের কোনো বাড়ির কাজ দেওয়া হয় না। যেন বাড়িতে তারা চাপমুক্ত থেকে আনন্দের সাথে পারিবারিক কাজ বা আড্ডা, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে পারে। আমেরিকায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শুয়ে বা বসে যে কোনোভাবে বন্ধুর মতো টিচারের ক্লাস উপভোগ করতে পারে।
কিন্তু আমাদের দেশে স্টুডেন্ট-টিচার সম্পর্ক যেন চোর পুলিশের মতো। স্টুডেন্ট যদি টিচারদের ভয় পায় তাহলে তাদের মনের ভিতরে জানার আগ্রহ উদয় হয় না। হলেও সেটি জানা তাদের জন্য কঠিন হয়। এদেশে যখনই কোনো নতুন শিক্ষাক্রম এসেছে তখনই অধিকাংশ টিচার সেটিকে স্বাদরে না গ্রহণ করে, বিরূপ মন্তব্য করেছেন এবং আনন্দ দূরে থাক অধিকাংশ টিচার সংশয়ের জ্বর নিয়ে ক্লাস পরিচালনা করেছেন।

আমাদের টিচারদের নতুন শিক্ষাক্রম দেখলে সংশয়ের জ্বর হবার ঢের কারণও আছে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে যারা শিক্ষা দেন তারা অধিকাংশ ৫ দিনে অনার্স এবং মাস্টার্স পাশের অর্ন্তভূক্ত। (তথ্যসূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস, ৪ অক্টোবর, ২০২৩;জুম বাংলা নিউজ,৫ অক্টোবর, ২০২৩)

আর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমান গুগল শিট এবং পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড দেখে দেখে ক্লাস পরিচালনা করা টিচার কিভাবে নিয়োগ হয় সেটি বলাই বাহুল্য। তবে শিক্ষাক্রম যাইহোক, নোটবই প্রস্তুতকারী কোম্পানি যে কোনোভাবেই হোক শিক্ষার্থীদের সামনে নোটবই হাজির করে। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষার্থীদের নোট বই কিনতে বাধ্য করে। যদিও সরকার নোটবই প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং ক্লাসে নোটবই অনুসরণ নিষিদ্ধ করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায় ক্লাসে সরকার-প্রদত্ত বাংলা এবং ইংরেজি গ্রামারসহ অন্যান্য মূল বই অনুসরণ না করে টিচাররা বাজারের নোটবই অনুসরণ করেন। শিক্ষাক্রম নতুন বা পুরনো যাই হোক না কেন, আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার আগে জ্বর এবং মুখস্ত করতে করতে অসুস্থ হওয়া নতুন নয়। সেটি বিসিএস এর মতো নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রথম সারির অংশীদার স্টুডেন্ট-টিচার। এবারই প্রথম এই দুই শ্রেণি শিক্ষাক্রমকে স্বাদরে স্বাগতম জানিয়েছেন। যদিও টিচাররা এখনও বিষয়টি সম্পূর্ণ আয়ত্ব করতে পারেননি।

জনশ্রুতি আছে, কিছু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে টিচার একজন শিক্ষার্থীর কানে কানে বললেন অমুকের একটি কালো সন্তান হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার পাশের জনকে কথাটি বলতে বললেন। শেষ শিক্ষার্থী বলল যে, সে শুনেছে- অমুকের একটি কাক হয়েছে। শিক্ষাক্রমে নিযুক্ত হওয়ার পর যোগ্য করে তোলা কঠিন। তাই যোগ্য টিচার নিয়োগ দিতে হবে।
শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মুল্যায়ন-ভিত্তিক নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে সেটির কনটেন্ট দেশের জন্য উপযোগী করে টিচারদের হাতে মূল্যায়নে ভার ছেড়ে না দিয়ে সচিবালয় থেকে সুন্দর সুন্দর শিক্ষাক্রম প্রনয়ন করে যথাযথ তদারকি করতে হবে। তা না হলে কালো সন্তানের পরিবর্তে কাক এবং ভিকারুন নেছা নুন স্কুলের পরিমল জয়ধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের মহৎ উদ্দেশ্য বুমেরাং হতে পারে।

লেখক: এমফিল গবেষক(এবিডি), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here