নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন রূপম

38

আইসিসি বিশ্বকাপ-২০১৫ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ নিয়ে দু’ দেশে রীতিমতো দামামা বাজছে। এরই মধ্যে কলকাতার সংগীত শিল্পী রূপম ইসলামের একটি স্ট্যাটাসকে ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিষয়টি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরলেন এবং জানালেন, এটা বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে নয়। মুঠোফোনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ওয়ালিউল মুক্তা

বাংলা ট্রিবিউন:আ‌‌পনি বাংলাদেশকে আঘাত করে স্ট্যাটাস দিলেন কেন? নাকি বিষয়টি এভাবেই ধারণ করেন?

রূপম:এটা পুরো ঘটনা নয়। একটি বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছি। কিন্তু মূল বিষয়টি খেয়াল করে কেউ পড়েনি। আমি কথা বলেছি, একজন মিউজিশিয়ানকে নিয়ে। তিনি হচ্ছেন তুর্য (মাইলস ব্যান্ডের ড্রামার জিয়াউর রহমান তুর্য)। আমি সরাসরি কাউকে অপমান করতে পারি না। তাই নামটি বলিনি। ম্যাকসহ (মাকসুদ) ঢাকার অনেক ব্যান্ডের সদস্যরাই আমার গুরুস্থানীয়। কিন্তু তুর্য হঠাৎ করে এটি করেছে।

বাংলা ট্রিবিউন:আসলে কী ঘটেছিল তখন?

রূপম:আমার স্ত্রী রূপসা দাসগুপ্ত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল। সেখানে সে লিখেছিল, ‘কিছু বন্ধু আইসিসিকে বলছেন, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল।….’ তখন আমাদের পারিবারিক এক বন্ধু গালিব সেখানে একটি কমেন্ট দেয়। কিন্তু তুর্য স্ট্যাটাসটি শেয়ার দেয় এবং আমার স্ত্রীকে গালি দিয়ে লেখেন ‘বিচ… লে অফ’। এটা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। পরে আমি তাকে ছোটলোক আখ্যা দিয়ে এটি লিখেছি। কোথাও বাংলাদেশ শব্দ বলিনি। এটা আমার স্ট্যাটাসটি পড়লেই বোঝা যাবে।

সেই ম্যাচকে ঘিরে এখন আমরা একে অন্যের জীবনকে আক্রমণ করছি। এটা বাঙালি আচরণের মধ্যে পড়ে না। তার (তুর্য) কথাতেও সে আচরণের ছিঁটেফোটা নেই। আমরা দুই বাংলা মিলেমিশে আছি। অনেকেই জানে না, আমর অ্যালবাম প্রথম হিট হয়েছিল বাংলাদেশে। ‘তোর ভরসাতে’ নামের এ অ্যালবাম ‘৯৯ সালে প্রকাশ পায়। কলকাতার লোকেরা গ্রহণের আগে বাংলাদেশিরা আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে। ‘৯২ সালে যখন ব্যান্ড তৈরি করি তখনও বাংলাদেশের ফিডব্যাক, মাইলস, জেমস ভাই, আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের গান শুনে শুনে শিক্ষা নিয়েছি।

৯৮’ সালে কলকাতার কাগজে সংগীত নিয়ে কলাম লেখা শুরু করি। সেসময় ম্যাক ভাইয়ের একটি ইন্টারভিউ প্রকাশ করেছিলাম। আমার যখন অ্যালবাম তৈরি করি তখন বাংলাদেশের একজন আমার সঙ্গে ছিল। গোড়া থেকে এখন অবধি সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

সংগীতবিষয়ক একটি পত্রিকা আমি নিজে সম্পাদনা করি। সেখানে আইয়ুব বাচ্চুর সাক্ষাতকার ছেপেছি। বাংলাদেশকে আমি সংস্কৃতির জমিন মনে করি। আমি কেন আক্রমণ করে বসব? একটি ব্য‌‌‌ক্তিগত স্ট্যাটাসে সেই ব্যক্তিকে ন্যূনতম সম্মান দিতে চেয়েছি, নাম প্রকাশ না করে। আমি তার আচারণ নিয়ে কথা বলেছি। তাকে আমার বাঙালি ও বাংলাদেশি মনে হয়নি। তার মধ্যে বাঙালিয়ানা তো নেই, এমনকি বাংলাদেশিয়ানাও নেই। আমি নাম ধরে অসম্মান করতে চাইনি।

বাংলা ট্রিবিউন:তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

রূপম:এখানে যদি তার নাম ধরে বলতাম তাহলে এ ভুল বোঝাবুঝি হতো না। অনেক মানুষ ভেবেছে, বাংলাদেশেকে বলেছি। তাদের কাছে আমি নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। যারা আঘাত পেয়েছেন তারা ক্ষমা করবেন। আমি আবারও সেই স্ট্যাটসটি পড়ে শোনাচ্ছি- ‘আর যাই করি এইসব ছোট লোকেদের আর কখনোই আমি মানুষের মর্যাদা দেব না। রেখেছো ‘ছোট লোক’ করে, মানুষ করোনি… স্যরি! এদেরকে যদি বাঙালি বলি তাহলে আমি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাব। হয় আমি বাঙালি, বুকের পাঠাওয়ালা, ‘হেরে গিয়ে একে ওকে দোষ দিয়ে প্যানপ্যানানি গাওয়া না’, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো শত অবিচার সহ্য করে নিয়ে মাঠে জবাব দেওয়ার মতো বাঙালি; অথবা এরা। এই ধরনের ছোটলোকামির কোনও প্রয়োজন ছিল কি?

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি নতুন পাকিস্তানির কথা বলেছেন। ‘নতুন পাকিস্তানের অভ্যুদয় সহ্য করছি’ এ বাক্যটি ছিল।

রূপম:নতুন পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ- এটা কোথায় লিখলাম? এটা মনোবৃত্তির কথা বলেছি। বাংলাদেশিদের নয়। আমি তাদের জন্য বলেছি যে, যারা এ রকম কথা বলতে পারে। আমি তো তার নাম নিতেই পারতাম। তাদের নাম আমি নিইনি। আর সে সময় আমার মাথায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসেইনি।
বাংলা ট্রিবিউন:আপনার কী মনে হয়, আদৌ পাকিস্তানের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

রুপম:এটা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তাই আমি নিশ্চয়ই কথা বলতে পারি না।

বাংলা ট্রিবিউন:আপনার এত রাগান্বিত হওয়ার কারণ কি এটাই ছিল?

রূপম:কিছু মানুষের মানসিকতা আমি মেনে নিতে পারিনি। আর একটা বিষয়, ম্যাচ শেষে অনেকেই বলছেন, ইন্ডিয়া চুরি করেছে। ইন্ডিয়া চোর। এটা ঠিক নয়, প্রতিকূলে ম্যাচ যেতেই পারে। এর ফলে ইন্ডিয়া কেন চোর হবে, আমার স্ত্রীকে কেন গালি দেওয়া হবে। আমি তো সেই ম্যাচের আম্পায়ার বা সংশ্লিষ্ট কেউ নই ।

বাংলা ট্রিবিউন:সেই বির্তকিত তিনটি আউট সম্পর্কে আপনার মত কী? আম্পায়ারের সে সিদ্ধান্ত কি ঠিক বিচার ছিল বলে মনে করেন?

রূপম:কথাটি অন্যভাবে বলতে চাই। ভারতের বিপক্ষে বহু অবিচার আমি দেখেছি। এগুলো ভারতের সঙ্গে বহুবার হয়েছে। বড় টিম হতে গেলে এগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। সৌরভ গাঙ্গুলীর বেলায় অনেকবার হয়েছে। দাদা মুখ বুজে সহ্য করেছেন। তখন বুঝতাম না। এখন বুছি দাদা কেন জবাব দিতেন না। কারণ নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা জবাব মুখে নয়, মাঠে দিতে হবে। আমার খুব আস্থা আছে বাংলাদেশের ওপর। তারা জবাবটা মাঠেই দেবে।

বাংলা ট্রিবিউন:আপনার চোখে বাংলাদেশ কেমন দল?

রূপম:এর আগে যতগুলো ম্যাচ দেখেছি আমি বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছি। এটা শুধু বিশ্বকাপেই নয়। আগেও হয়েছে। আমরা তো ভারতীয় তাই ভারতকে সমর্থন করব- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের পরেই বাংলাদেশ। কারণ আমি বাঙালি।

বাংলাদেশের এবারের বিশ্বকাপের খেলা আমার খুব ভালো লেগেছে। এখানে সবার একই মত হবে। এটা দুর্ভাগ্যজনক তিনটি ডিসিশন বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। আর এতে কিন্তু ভারতের খেলোয়াড় তো নয়ই, আমরাও কিন্তু দোষী নই। সাধারণ মানুষ কিন্তু কখনই চায় না চোট্টামি করে দল জিতুক। আনন্দবাজার পত্রিকায় আমি বলেছি, বাংলাদেশ যদি জেতে সম্পূর্ণ কৃতীত্বে। টুপি খুলে আমি তাদের কুর্ণিশ জানাব। নাড়ির টান রয়েছে ওপার বাংলায়। ফিউচার চ্যাম্পিয়নের দল এটা। আমি তাদের মধ্যে সে মসলা দেখেছি।

বাংলা ট্রিবিউন:আপনার গান কলকাতা থেকে বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়। সে দিক থেকে বিবেচনা করে এ ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশে আপনার ফ্যানরা যেভাবে নিয়েছে সেটাকে কীভাবে দেখছেন?

রূপম:দেখুন, ফ্যানরা রিঅ্যাক্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থে কী মিন করে বলেছি, কোন প্রেক্ষিতে বলেছি এবং যেভাবে কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা আমার বক্তব্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে সেটাও ফ্যানরা বুঝবেন বলে আমি বিশ্বাস রাখছি। বাংলাদেশ আমার কাছে কেমন- সেটা আমার আ‌‌‌শেপাশের মানুষরা খুব ভালো করে জানে। আমি বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক ভাবি। আমার লেখা প্রত্যেকটি বই বাংলাদেশ নিয়ে একটি আলাদা পরিচ্ছেদ থাকে। বাংলাদেশকে নিয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গে নিয়মিতই কাজ করি।

আমার প্রিয় লেখক- হ‌‌‌ুমায়ূন আহমেদ। প্রিয় চরিত্রের নাম অন্যান্য বাংলাদেশিদের মতোই- হিমু। দূর দুঃস্বপ্নেও বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে বাঁচবার কথা আমি ভাবি না। আমার লেখা নতুন বই ‘রকস্টার’-এ একটি প্রবন্ধের নাম- আমার প্রিয় লেখকের চরিত্র নিয়ে ‌’মিসির আলী সমীপেষু’। সুতরাং আমি ভক্তদের বলব, আমার অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার। আমি আমার লেখার কোথাও বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণই করিনি। সুতরাং কয়েকজনের বিরুদ্ধে লেখা বিষয়টি আপনার নিজেদের ওপর নেবেন না