জানলে আমি এই জালে জড়াতাম না

43

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামে গৃহবধূ ববিতাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে চালানো হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। সদর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সেই বিভীষিকা স্মরণ করে আজও বারবার শিউরে উঠছেন এই নারী। তার পরও নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলেছে প্রভাবশালী পরিবারটি।
বর্বর নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে গত ৩০ এপ্রিল। কিন্তু প্রভাবশালী পরিবারটির পাশাপাশি গ্রাম্য মাতব্বর এমনকি থানা পুলিশও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু গাছে বেঁধে নির্যাতনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ হয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার পাঁচ দিন পর ববিতার মা খাদিজা বেগম ৫ মে লোহাগড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলায় গ্রাম্য মাতব্বর আজিজুর রহমান, ববিতার স্বামী শফিকুল, শ্বশুর সালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিনা বেগম, ভাসুর হাসান শেখ, চাচা-শ্বশুর কালাম শেখসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের শালবরাত গ্রামের ছালাম শেখের ছেলে সেনা সদস্য (সিলেট সেনানিবাসের ৩৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত) শফিকুল শেখের সঙ্গে পাশের এড়েন্দা গ্রামের ইসমাইল মোল্যার মেয়ে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ববিতার (২১) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সম্পর্কের জের ধরে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর তারা গোপনে বিয়ে করে। কিন্তু শফিকুলের মা ববিতাকে ঘরে তুলে নিতে আপত্তি জানায়। শফিকুলও ববিতার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। একপর্যায়ে ববিতা আদালতের শরণাপন্ন হলে শফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়।
খাদিজা বেগম জানান, ২৯ এপ্রিল শফিকুল বাড়িতে আসে এবং মীমাংসার কথা বলে তাঁর মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য খবর দেয়। ববিতা খুশি হয়ে রাতেই স্বামীর বাড়িতে যান। কিন্তু ওদের মনে ছিল অন্য চিন্তা। পরদিন (৩০ এপ্রিল) সকাল ৭টার দিকে ববিতার স্বামী শফিকুল, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর সালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিনা বেগম, চাচা-শ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ এবং পাশের পদ্মবিলা গ্রামের আজিজুর রহমান আরজু তাঁকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। নির্যাতনের একপর্যায়ে ববিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় তাঁকে বাজারে নিয়ে একটি দোকানে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে লোহাগড়া থানা পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। ববিতাকে প্রথমে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে নড়াইল সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
নির্যাতিতার মা অভিযোগ করে বলেন, সেনা সদস্য হওয়ায় শফিকুলের বিরুদ্ধে এলাকায় কেউ কথা বলতে সাহস করে না। এ কারণে চরম নির্যাতনের পরও কেউ তাঁর মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। পুলিশও প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে শফিকুল তাঁদের হুমকি দিচ্ছে। তা ছাড়া ঘটনার পাঁচ দিন পরও আসামিদের গ্রেপ্তারে স্থানীয় থানা পুলিশের তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। একপর্যায়ে নির্যাতনের ছবি প্রকাশ হয়ে পড়লে পুলিশ গত মঙ্গলবার বাধ্য হয় মামলা নিতে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে শফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবা, ভাই, চাচাসহ পরিবারের তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে থাকা শফিকুলের ভাবি রুনা ও চাচি রত্না জানায়, মামলার আসামি হওয়ায় সবাই পলাতক। তাদের অভিযোগ, ‘৩০ এপ্রিল সকালে ববিতা ও তার মা আমাদের বাড়িতে আসে। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেল কেনার জন্য বিছানার নিচে রাখা এক লাখ টাকা ওরা হাতিয়ে নেয়। এ সময় চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। চোর সন্দেহে এলাকার মহিলারা ববিতা ও তার মাকে পেটাতে থাকে। এরপর বাইরে কী ঘটেছে তা আমরা দেখিনি।’
ববিতার বড় ভাই হাদিউর রহমান বলেন, ‘ঘটনার পরপরই আমরা থানায় মামলা দেবার জন্য দৌড়াই। থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। অবশেষে ৫ এপ্রিল লোহাগড়া থানা মামলা নিয়েছে। এই কয়েক দিনে মামলা করলে আমাদের খুন করার হুমকি দিয়েছে এলাকার ঝন্টু ও আজিজুরের লোকেরা। তারা আমাদের বাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়েছে।’
ববিতার ভাবি জলি বেগম কাঁদতে কাঁদতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে ববিতা একটি নরম মেয়ে। আমরা অনেক আশা করে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছিলাম। এখন শ্বশুরবাড়িতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সবার সামনে মেয়েটি যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তা ভাবা যায় না।’
কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এলাকার মানুষের কাছে ববিতাকে নির্যাতনের খবর পেয়েছি। একজন নারীকে এভাবে গাছে বেঁধে মারধর করাটা জাহেলিয়া যুগের ঘটনার মতো। আমি লোহাগড়া থানার ওসিকে বিষয়টি দেখার জন্য বলি। তিনি তাৎক্ষণিক আমাকে জানান যে এটা কোনো মারাত্মক নির্যাতন নয়। আমি তাকে অন্তত ১০ বার ফোন করার পরও তিনি বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি।’
তবে লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান দাবি করেন, ‘ঘটনাটি আমাদের নজরে আসার পরপরই মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ইতিমধ্যে মামলার এক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।’
নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। নারী নির্যাতনের ব্যাপারে নড়াইল জেলা পুলিশ জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে। আমাদের ফোর্স সার্বক্ষণিকভাবে কাশিপুর এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অন্য আসামিরাও দ্রুতই গ্রেপ্তার হবে।’
সদর হাসপাতালে নির্যাতনের শিকার ববিতা বলেন, ‘আমি আমার জীবনটাকে একেবারে শেষ করে দিলাম। প্রেমের পরিণাম এ-ই হবে জানলে আমি এই জালে জড়াতাম না। আমার স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে মারধর করলেও মানা যেত। কিন্তু ওরা আমাকে গ্রামের অন্য লোক দিয়ে সবার সামনে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করেছে। লাঠির আঘাতে আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে। এর বিচার কে করবে? আর আমি এই মুখ কেমনে দেখাব!’
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার আসাদুজ্জামান মুন্সী বলেন, ‘মেয়েটির সারা শরীরে বিশেষত কোমরের নিচে ও হাতের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। মেয়েটি এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। তবে তার চেয়েও বড় কথা, ভয়াবহ নির্যাতনে মানসিকভাবেও সে বিপর্যস্ত। সবার উচিত মেয়েটিকে মানসিকভাবে সেরে উঠতে সহায়তা করা।’