কিন্ডারগার্টেনগুলো বন্ধের পথে, শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন

487
কিন্ডারগার্টেনগুলো বন্ধের পথে, শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের বড় মসজিদের সামনে থেকে পাঠাও রাইড শেয়ারিংয়ে একজনকে বাইকে তোলেন আজিমউদ্দিন (ছদ্মনাম)। বেশভূষায় পরিপাটি, মোটা গ্লাস ও ফ্রেমের চশমা এবং শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা চালকের আলাপে মুগ্ধ আরোহী।

কিছুদূর যাওয়ার পর আরোহী তার পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, এই মাহুতটুলির একটি কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলের অধ্যক্ষ তিনি। করোনায় দীর্ঘ ১৭ মাসের ছুটির ধকল কাটিয়ে উঠতে না পেরে তিনি স্কুলটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
শিক্ষক-কর্মচারী সবাইকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বাড়ির ছাদে চেয়ার-টেবিলসহ আসবাবপত্র রেখে জীবিকার তাগিদে এখন রাইড শেয়ার করছেন।

কেজি স্কুল সমিতির নেতারা বলছেন, শুধু আজিমউদ্দিন নন এমন অনেকেই জীবিকার তাগিদে পেশা বদলেছেন। কেউ হয়েছেন দোকান কর্মচারী। কেউ হয়েছেন সবজি ও ফল বিক্রেতা। কেউ আবার গ্রামে ফিরে কৃষি কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, কেজি স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী এবং উদ্যোক্তারা এক কথায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রায় সবাই পেশা বদল করেছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) গত মে মাসে বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস-২০২০-এ উল্লেখ করা হয়েছে, সারা দেশে ৯ ধরনের ১ লাখ ৩৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন, শিক্ষক ৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৭১।

এগুলোর মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৭টি কেজি স্কুলের শিক্ষার্থী ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৩ জন এবং শিক্ষক ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৭ জন। যদিও কেজি স্কুলের নেতাদের দাবি, সারা দেশে এ ধরনের স্কুল আছে প্রায় ৬০ হাজার। আর এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী ১০ লাখ।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকই এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এগুলো আর চালু হবে না। ফলে অন্তত ৫ লাখ শিক্ষক আর এই পেশায় ফিরবেন না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র অর্থে বাড়ি ভাড়া, বিভিন্ন ধরনের বিল এবং শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হতো। করোনার কারণে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। আবার যারা ভর্তি হয়েছে তাদের অনেকেই ফি পরিশোধ করছেন না।
বার্ষিক পরীক্ষা না থাকায় এবং গত মার্চের পরে একদিনও না খোলায় প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সিংহভাগ পাওনাদি আদায় করতে পারেনি।

বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কিন্ডারগার্টেন
বন্ধ হয়ে গেছে এমন অনেক কিন্ডারগার্টেন

নাম প্রকাশ না করে বিভিন্ন কেজি স্কুলের শিক্ষকরা জানান, গত বছরের মার্চে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পর কয়েক মাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেতন-ভাতা দিয়েছে। পরে ছুটি বাড়তে থাকে এবং খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে, তখন তাদের বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত এ ধরনের স্কুলে শিক্ষকরা খুবই কম বেতন পান। টিউশনি করেই বেশির ভাগ শিক্ষক ব্যয়ের চাহিদা পূরণ করতেন।

কিন্তু সেই টিউশনিও বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলে উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন তারা। এ অবস্থায় স্বজন, পরিচিতজন ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে অনেকে কোনোমতে বেঁচে আছেন। ধার-দেনার পথও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা বদলেছেন।

আজিমউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ডিসেম্বর পর্যন্তও ভবনটি ধরে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন জানুয়ারি থেকে ক্লাস চালু হবে। মাসে ৭০ হাজার টাকা করে ভাড়াও চালিয়ে রাখেন। এখন আর সেই সক্ষমতা নেই। তাই ভবনটি ছেড়ে দিয়েছেন। ভবনের মালিক ৩ মাসের ভাড়া পাবেন।

রাজধানীর ভাটারায় একই ধরনের স্কুল খুলেছিলেন পটুয়াখালীর আবুবকর সিদ্দিক। স্কুল খোলার অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হচ্ছে না। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দক্ষিণ গেটসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ওই স্কুলে তিনি একইসঙ্গে কোচিং সেন্টারও চালাতেন। গত ১৭ মাস ধরে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আবুবকর জানান, বাড়ির জমি বিক্রি করে ভাড়া দিচ্ছেন। তবে তার আফসোস একটু কম এ কারণে যে, তিনি সেখানে মেস ভাড়া দিয়ে ক্ষতি কিছুটা নামিয়ে রেখেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরের কেজি স্কুলগুলোরও একই পরিস্থিতি। যশোরের বেনাপোল ও শার্শায় ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় প্রায় ৫৫টি এ ধরনের স্কুল আছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন। ১১ হাজার শিক্ষার্থীর টিউশন ফিতে পরিচালিত হতো শিক্ষক ও উদ্যোক্তাদের সংসার। ১৭ মাসে ধার-দেনার সুযোগও শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের দিশেহারা অবস্থা।

বেনাপোলের চেকপোস্ট আইডিয়াল কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়ানুর রহমান বলেন, স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সব ধরনের আয়-রোজগারও বন্ধ। মাসে ১৫ হাজার টাকা স্কুলের ঘর ভাড়া। বাড়িওয়ালা চাপ দিচ্ছেন। অভিভাবকদের কাছ থেকে স্কুলের বেতন আদায় হচ্ছে না। চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।

আর শার্শা উপজেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুতালহা জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যেমন আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে শত শত শিক্ষক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিক সহযোগিতা দেয়নি। ১ লাখ ৩৩টি স্কুলের মধ্যে সাড়ে ৬৫ হাজার সরকারি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে কিছুপ্রতিষ্ঠান। বাকি সবই বেসরকারি। সরকার এখন পর্যন্ত দুই দফায় ৮০ হাজার ৭৪৭ শিক্ষক ও ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারীকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, যেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। ফলে কেজি স্কুলের শিক্ষকরা সহযোগিতা বঞ্চিত আছেন।

কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, বিগত ১৭ মাসে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ এমন কাউকে বাকি রাখিনি যাদের কাছে আমরা যাইনি। আমরা আর্থিক সহযোগিতা, সহজ শর্তে ঋণ, স্কুল খুলে দিয়ে ভর্তিকরার সুযোগসহ নানা বিকল্প চেয়েছি। কোনো সাড়া পাইনি। উপরন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যে, কেজি স্কুলগুলো তাদের নয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার কয়েক বছর আগে কেজি স্কুলগুলোকে বিধি-বিধানের অধীনে আনার উদ্যোগ নেয়। তখন রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দায়বদ্ধতার অধীনে এসেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আসলে কোনো মন্ত্রণালয়েরই অধীনে নেই।
কিন্তু এরপরও যেহেতুএদের নাগরিকদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে তাই বাধ্য হয়ে সরকার সেখানে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে থাকে এবং পিইসি পরীক্ষা নিয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আবেদন করলেও সেগুলো ঝুলে আছে বছরের পর বছর। অনেক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনও করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত ফলাফল আসেনি।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় ১ কোটি ছেলেমেয়ে কেজি স্কুলগুলোতে লেখাপড়ার করে। সরকার যদি এত ছেলেমেয়েকে পড়াতে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষক নিয়োগ করত, তা হলে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হতো।
তাই জাতীয় স্বার্থেই তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা সরকারের দায়িত্ব। কেননা, এত ছেলেমেয়ের জন্য যেমন হঠাৎ স্কুল গড়া সম্ভব নয়, তেমনি প্রশিক্ষিত শিক্ষক পাওয়া যাবে না।
এদিকে নজর না দিলে সরকার তথা দেশেরই বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র : যুগান্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here