বাংলাওয়াশের গর্জনে বিপন্ন ব্র্যান্ড ধোনি: আনন্দবাজার

15

হিংস্র মুখগুলো ঝুঁকে পড়ছে রেলিং ধরে, মাঠ দিয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে হেঁটে আসতে দেখে গলার শিরা ফাটিয়ে ততধিক বাড়ছে বিদ্রুপের মওকা, মওকা.. চিৎকার। শান্ত ভারত অধিনায়ক ওপরে তাকালেন একবার। হেসে হাত দিয়ে যেন বোঝাতে চাইলেন, আমি নই। ও সবের পিছনে আমি নই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মীরপুর প্রেস কনফারেন্স রুম আর অভিমানের বহিঃপ্রকাশ, সরিয়ে দিন আমাকে। দেশের ক্রিকেটের তাতে ভাল হলে সরিয়ে দিন! আর কিছু ভাবতে না পেরে মাঠে শুধু লাফাতেই শুরু করে দিলেন মাশরফি মর্তুজা। কে বলবে, তাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা এক নয়, দুই নয়, ছয়! উনিশের এক বাঙালি পেসারকে দেখা গেল এ বার এক ঝলক। অধিনায়কের সিংহ-হৃদয়ে মুখ লুকিয়ে। সস্নেহে একটা হাত অবিরাম ঘুরে যাচ্ছে পেসারের মুখে, হাতে, চুলে। অধিনায়কের হাত। জালের প্রাচীরটা এত উঁচু কেন এত দিনে বোঝা গেল। নইলে ওই যে উন্মত্ত দর্শককুল, তাদের আজ ঠেকাত কে? ওরা এখন প্রাচীর ধরে ঝুলছে, টানছে, ভেঙে ফেলতে চাইছে নায়ক আর সাধারণের বিভেদের দেওয়ালটা। মুস্তাফিজুর রহমানকে আজ না ছুঁয়ে দেখলে আর কবে দেখবে পদ্মাপার? সাকিব-আল-হাসানকে আজ একবার জড়িয়ে না ধরলে জীবনে আর থাকল কী?

হাজার-হাজার বোতল রাতের ঢাকা আকাশে ছুঁড়ে, বাঘের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে, বুকে ডোরাকাটা দাগ এঁকে, ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে রবিবাসরীয় মীরপুরে নতুন ক্রিকেট-সূর্য এনে ফেলল বাংলাদেশ। ভারতকে প্রথম বারের জন্য ওয়ান ডে সিরিজে হারিয়ে দেশের ক্রিকেটকে এ বার ইতিহাসের পাতায় তুলে ফেললেন মাশরফি মর্তুজার টিমের এগারো বাঙালি। তিন ম্যাচের সিরিজ রবিবারেই শেষ, অন্তিম ম্যাচ এখন মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের সম্মানরক্ষার প্রয়োজনেই পড়ে। কোনও সন্দেহ নেই ঢাকা আজ ঘুমোবে না। কুমিল্লা ঘুমোবে না। চট্টগ্রাম ঘুমোবে না। প্রথমে নিউজিল্যান্ড। তার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাকিস্তান। শেষে ভারত। সোনার বাংলার ক্রিকেট-ইতিহাসে নতুন স্বর্ণ পালকের জন্ম হয় যে রাতে, সেখানে আর ঘুমনো সম্ভব?

রবিবারের মীরপুর স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকলে যে কোনও ভারত সমর্থকের পারিপার্শ্বিক দেখলে প্রচণ্ড কষ্ট হবে। একটা টিম আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে দুইয়ে। অন্য টিমটা সাত নম্বরে। সাধারণ ক্রিকেট-বোধ বলে প্রথম ম্যাচ যদি কোনও ভাবে হেরেও যায় র‌্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বর, তা হলে পরেরটায় সে ফিরে আসবে প্রত্যাঘাতের চাবুক নিয়ে! বিপক্ষকে চূর্ণ করে অক্ষত রেখে দেবে সম্মানের তাজ। আর সম্মান! যে ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল ধোনিদের প্রত্যাবর্তনের ম্যাচ, সেখানে ভারতবর্ষ তার সেরা এগারোর থেকে উপহার পেল কুত্‌সিততম পারফরম্যান্স। ব্যাটিংয়ে, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংয়ে। আচার-ব্যবহারে। উপমহাদেশের বাইরে ভারতীয় ব্যাটিং নিয়ে এত দিন প্রচলিত বিদ্রুপ ছিল, বল নড়ে, উইকেট পড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে ওটা উপমহাদেশেও খুব ভাল নড়ে! ভাবা যায়, রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলির ভারত পঁয়তাল্লিশ ওভার টিকতে পারছে না। দুশো তুলতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষের বাঁ হাতি পেসারকে এমন আতঙ্কের চোখে দেখছে যেন, কোনও এক ওয়াসিম আক্রম দৌড় শুরু করছেন!

বাংলাদেশ বাঁ হাতি পেসার নিঃসন্দেহে মারাত্মক প্রতিভা। আজকের পর মুস্তাফিজুর রহমানকে অনায়াসে সাতক্ষীরা সায়নাইড বলে ডাকা যেতে পারে। গত পাঁচ দিনে দু’টো ম্যাচ খেলে এগারোটা উইকেট নিয়েছেন। দুটো ম্যাচ মিলিয়ে দু-দুইবার হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এমএস ধোনি থেকে সুরেশ রায়না কাউকে পাল্টা মারের বিষ ছড়াতে দেননি। ‘সায়নাইড’ তো তিনি বটেই। তাঁর স্লোয়ার কাটারগুলো যখন দুঁদে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের টুঁটি ছিড়ে নেয়, নিঃশব্দ মৃত্যুদূতের বাইরে মুস্তাফিজুরকে আর কিছু মনে হয়নি। পরপর দুই ম্যাচে পাঁচ উইকেট তোলা, ক্রিকেট-বিশ্বে আজ পর্যন্ত জিম্বাবোয়ের ব্রায়ান ভিট্টোরির বাইরে কেউ করে দেখাতে পারেননি। মুস্তাফিজুর নিলেন আবার ছয়টা।

কিন্তু তার পরেও মুস্তাফিজুর আনপ্লেয়বল নন। অন্য কেউ নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট যাঁরা গুলে খেয়েছেন তাঁরাই কথাটা বলছেন। বাংলাদেশ সাংবাদিককুলের ধারণা হল, ভারত মুস্তাফিজুর-আতঙ্ককে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। তার পরিণাম এটা। আসল সত্যিটা কী, বলা মুশকিল। কিন্তু ইতিহাস সে সবে আগ্রহী হবে না। সোনার বাংলার ইতিহাস বলবে, মুস্তাফিজুরই ভারতের বিরুদ্ধে তাদের সেরা গর্বের রাতটা উপহার দিয়েছিল। এবং গর্ব করার মতো, কলার তুলে হাঁটার মতো পারফরম্যান্স। শোনা গেল, ম্যাচ শেষে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে এমএসডি-র কাছে নাকি মুস্তাফিজুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন মাশরফি মর্তুজা। আইপিএল দরজা খোলার সম্ভাবনা ছেলের আছে কি না জানতে। ধোনির কাছে একটা ব্যাটও নাকি চেয়েছেন দেশের এক নবীন প্রতিভাকে উত্‌সাহিত করতে। রবিবার অন্তত যার খুব একটা প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। এমন অবিশ্বাস্য বোলিং স্পেলের পর উত্‌সাহের নতুন টনিক লাগে নাকি?

১০-০-৪৩-৬!
রোহিত শর্মাকে দিনের দ্বিতীয় বলে তুলে নেওয়া দিয়ে যার শুরু। রবীন্দ্র জাডেজাকে বোল্ড করে যার শেষ। ইনিংসের দ্বিতীয় বলে যে ড্রাইভটা খেললেন রোহিত, মনে হয় না তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁর কাছেও আছে বলে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ‘লুজ শট’ বললেও তাকে অপমান করা হয়। এবং ছত্রিশ থেকে চুয়াল্লিশ ওভার ভারতীয় ইনিংসের আট ওভারের একটা সময়ে সাক্ষাত্‌ ‘মৃত্যুদূত’ হিসেবে আবির্ভূত হলেন মুস্তাফিজুর। আর কচুকাটার নমুনা এ রকম:
রায়না: শর্ট। কাটার মেশানো। টেনিস বলের মতো বাউন্স করে ভারতীয় মিডল অর্ডারের বাঁ হাতির ব্যাট ছুঁয়ে কিপারের কাছে চলে গেল।
অক্ষর পটেল: সোজা এল, প্যাডে পড়ল এবং এলবিডব্লিউ।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন: অফকাটার, খোঁচা ও ড্রেসিংরুম।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি: মারাত্মক কাটারটা বুঝতেই পারলেন না। অনেক আগে শটের জন্য ব্যাট বাড়িয়ে দিলেন। বলটা থমকে ব্যাটে লেগে শর্ট কভারে চলে গেল।

সবচেয়ে খারাপ ধোনির জন্যই লাগবে। বহু দিন পর তিনি এ দিন ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বরে উঠে এসেছিলেন। মীরপুরের ভারতীয় ইনিংসে ‘চেষ্টা’ বলে যদি কোনও শব্দ ব্যবহৃত হয়, ধবন ছাড়া ধোনির ক্ষেত্রেই ওটা করতে হবে। ৭৫ বলে ৪৭ ব্র্যান্ড এমএসডি নয়, কিন্তু তাতে টিমকে টেনে সম্মানের তটভূমিতে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভারত অধিনায়ককে কেউ একটা পার্টনারশিপই দিতে পারলেন না। পিচ-চরিত্র খুব ভুল ধরেননি ধোনি। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে খেলতে পারছিল না বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত অধিনায়ক দেখলেন, তাঁর হাতে অশ্বিন ছাড়া কোনও স্পিনার নেই। দেখলেন, বিশ্ব ক্রিকেটের বড়দা হয়েও তাঁর টিমের প্লেয়াররা মেজাজ হারিয়ে ফেলে চাপে পড়লে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহেতুক তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়ে। টিপ্পনী ছোঁড়ে। দেখলেন, এত দিন যে তেতো ওষুধ বিপক্ষকে গিলিয়ে থাকতেন দেশের মাঠে, তা বাঘের ডেরায় এখন ওঁত পেতে নির্নিমেষ অপেক্ষা করছে তাঁরই জন্য। তাঁর টিমের জন্য। নামটা শুধু আলাদা। ব্রাউন নয়, বাংলাওয়াশ!