যুদ্ধ কেমন হয়, নিজ চোখে দেখলাম

যেভাবে বিদায় হয়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকার

11
যেভাবে স্বাধীনতা এসেছিল

এই ছবিটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
সময়: ৩টা ৫০ মিনিট (আনুমানিক)
স্থান: কোটবাড়ি বিশ্বরোড, কুমিল্লা
পুলিশ আমাদের সবাইকে মুহুর্মুহু গুলি করে পেছনের দিকে নিয়ে যায়। সবাই দৌড়াদৌড়ি করতেছিল। সমানে ছড়া বুলেট, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। আমাদের সাথের একটা ছেলের পায়ে গুলি লাগে। সে কাতরাচ্ছে। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাকে আনতে যাবো পুলিশ সমানে গুলি করা শুরু করে। আমরা কয়েকজন ছিলাম। তাৎক্ষণিক কোথায় যাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম নাম। পাশে একটা মাচার হোটেল। এই হোটেলের নিচে জলাধার। মাচার নিচে সবাই এদিকে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করলাম। তখন আমরা ৫-৬ জন ছিলাম। পুলিশ তখনো গুলি করতেছে। আমাদের মধ্য থেকে ৩ জন পানিতে নেমে ধীরে ধীরে অন্য একটি রাস্তা দিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যায়। আর বাকী থাকলাম আমরা ৩ জন। তারমধ্যে একজন ছিল জলাধারের দিকে আর আমরা ২ জন ছিলাম একটু শুকনো জায়গায়।
শুকনো জায়গাটার একটু বিবরণ দেওয়া জরুরি মনে করছি। কাঠের কয়েকটি বীম করা। ১/১.৫ ফুটের মতো দুইপাশে মাটি আটকানোর জন্য বেড়া দেওয়া (ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন)৷ সম্পূর্ণ জায়গাটা সবমিলিয়ে ২ ফুটেরও কম। ২ জন দুইজনকে চেপে ধরে আছি। তখন কিছু পুলিশ ঐ বিচ্ছিন্ন ভাইটিকে দেখে ফেলে। সে সরাসরি স্যারেন্ডার করে। মাফ চায়। কিন্তু তখনও ওরা আশেপাশে গুলি করতে থাকে। পরে সে আবর্জনাযুক্ত ঐ জলাধারে লাফ দেয়। জীবন তখন তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এক ডুবে প্রায় ২-৩ মিনিট তার কোনো খবর নেই।
ততক্ষণে পুলিশ এই জায়গাটায় সমানে গুলি করতেছে। কোনো রাবার বুলেট না। ছড়া বুলেট না। সরাসরি গুলি। আমাদের থেকে ৩-৪ ফুট দূরত্বে গুলিগুলো কাঠের বীমে এসে বিঁধে যাচ্ছিলো। আমার পাশের ছেলেটিকে তখন বললাম ভাই, দরুদ শরিফ পড়ো। মনে হয় না এই দফায় আর বেঁচে ফিরতে পারবো। আর যদি এখানে মরেও যাই, কেউ সহজে আমাদের খুঁজে পাবে না। আল্লাহর সরাসরি সাহায্য লাগবে।
দুইজনের সামনেই যেন মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছিল। কালেমা পড়ে ফেলছি। কী দেখলাম ভাই! শুধু গুলি আর গুলি। কমপক্ষে ১০-১৫টা গুলি করেছিল এই জায়গাটায়। সময় যাচ্ছে না। পুলিশের কথাবার্তা শুনছি। যেই ছেলেটার পায়ে গুলি লেগেছিল, সে মাফ চাইতেছে। পুলিশ তখন তাকে মাদার*দ বলে একটা গালি দেয়। বলে দৌড়া, এখন কেন দৌড়াচ্ছিস না।
ছেলেটার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তখন মনে হচ্ছিল এখানে আমরা দুইজন এখনও আছি এটা টের পেলে আবার গুলি করবে।
পুলিশের কয়েকটা গাড়ি এসে জায়গাটায় থামলো। একদম নিশ্চুপ হয়ে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতেছিলাম। কিছুক্ষণ পর আরেকদিকে আমার ভাইয়েরা আবারও ঢিল ছোড়াছুড়ি শুরু করলে পুলিশ এখান থেকে চলে যায়।
এই সময়টা ছিল প্রায় ১৫ মিনিটের মতো।
পৃথিবীর দীর্ঘতম ১৫ মিনিট।
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ১৫ মিনিট।
পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ওর নাম জিগ্যেস করি। বললো রিফাত। পলিটেকনিক পড়ে। বাড়ি বুড়িচং। আমার কানে এখনও তার ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছি। ওকে বলতেছিলাম, সাহস রাখো। এই যাত্রায় বেঁচে গেলে আমরাই জয়ী হবো।
পুরো ঘটনা ও ছবিটা পোস্ট করে রাখলাম।
যদি এই যাত্রায় আমরা জয়ী হই, আমাদের আন্দোলন সফল হয়, ইনশাআল্লাহ এই ঘটনা পরবর্তী প্রজন্মকে শুনাবো। যুদ্ধ কেমন হয়, নিজ চোখে দেখলাম। 🙂
১৮ই জুলাই, ২০২৪