মিডিয়ার নতুন ফতোয়া >> ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এখন আর মুক্তিযোদ্ধা নন !

63

ফরহাদ মযহার

কিছু গণমাধ্যম দাবি করছে একাত্তরে যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি এখন আর মুক্তিযোদ্ধা নন। তাদের যুক্তি মানলে এটাও মানতে হয় একাত্তরে যারা রাজাকার ছিল তারাও এখন তাহলে আর রাজাকার না। মানুষ মতান্ধ হয়ে গেলে কথাবার্তার ঠিক থাকে না।

এই সকল বাচাল বচন উপেক্ষা করলেও নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দিক থেকে তর্কগুলো কি সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট থাকা উচিত।

১. কোন আদালত কি সংবিধান, আইন এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান? আদালত কি সংবিধান বা আইনের উর্ধে? নাগরিক ও মানবিক অধিকারের বিধানাবলী মেনেই আদালত জনগণের কাছে নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করে। আদালত কি সেই দিক থেকে জবাবদিহিতার উর্ধে?

২. বিধিবদ্ধ আইনে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার (citizen rights) এবং একই সঙ্গে আইনেরও আগে বা আইনের বাইরে চিরায়ত মানবিক অধিকার (natural rights) – যাকে কোন সংবিধিবদ্ধ আইনে বাঁধা কঠিন -– সেই অধিকার কি আদালত ক্ষুণ্ণ করতে পারে? যদি পারে তাহলে নাগরিক অধিকারের বাইরে ‘মানবিক অধিকার’ (?) কথাটার অর্থ কি? এই অর্থেই উচ্চ আদালতে আপিল বা রিভিউর তর্ক আইনশাস্ত্র তোলে। যেন আইন নিজের সীমা নিজে তার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে বিচার ও উপলব্ধি করতে পারে। ‘বিশেষ আইন’-এর নামে সে কারনে কোন আদালত তার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিউ করা যাবে না এই অবাস্তব ও ন্যায়বিচার বিরোধী দাবি করে না। তাহলে যে দাবির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এই দাবি করে সেটা আইনী দাবি নয়, আইনশাস্ত্রের দিক থেকে তা অন্যায্য। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং একান্তই দলীয় রাজনৈতিক দাবি। এক দেশে নাগরিকদের জন্য দুই আদালতে দুই আইন অসঙ্গত ও ন্যায়বিচার বিরোধী নয় কি?

৩. বাংলাদেশে ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোন আইন আছে কি? সেটা কি? মুক্তিযুদ্ধের সংকল্প বা স্পিরিট ধারণ করে নাগরিকদের কথা বলা ও সমালোচনার অধিকার তো দূরের তর্ক। সুনির্দিষ্ট আইন থাকার অর্থ হচ্ছে আদালত কোন নাগরিককে যা খুশি শাস্তি দিতে পারে না, অপরাধ অনুযায়ী কি শাস্তি দিতে পারে সেটা আইন নির্দিষ্ট করে দেয়। সেটা আদালতের অবারিত ক্ষমতার এখতিয়ার নয়। আদালত অবমাননার নামে আদালত কি নিজেকে আইনের উর্ধে দাবি করছে? বিচারকরা কি তাহলে আদালত অবমাননার নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে না? ডা।. জাফরুল্লাহ চৌধুরি বলেছেন:

“এই আদালত অবমাননার একটি বিষয় আছে। সেখানে তিনটির একটি বিষয় প্রমাণ করতে হয়। আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, বিচারের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, আদালতের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করা।

বিচারপতিরা আদেশের কোথাও সুস্পষ্টভাবে বলেননি, কোন জায়গাতে আমরা বা বিশেষ করে আমি এই তিনটি বিষয় ভঙ্গ করেছি। তাদের যুক্তি নাই বলেই তিন বিচারপতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এ মামলার শুরু থেকে আজকেও তাই। পৃথিবীর মধ্যে এটা অভদ্রজনিত ব্যবহার, যখন রায় পড়েন তখন সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রাখা অর্থহীন। এটা মধ্যযুগের ঘটনা। কিন্তু তারা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তারপর বলেছেন বয়স, কিন্তু বয়সের সম্মান আমি তাদের কাছে কামনা করি নি। যুক্তি না থাকলে হঠাৎ একজনকে খুঁজে বের করা হয়। আমি বলেছি, আপনাদের এই আদেশ স্থগিত রাখেন যেন উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারি। তারা সেই সুযোগ না দিয়ে দ্রুত আদালত ত্যাগ করেছেন। এখন বিষয়টা আপনারা বিবেচনা করেন। সমালোচনা থেকে বিরত রাখার অর্থ হচ্ছে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা।”

৪. আইনের অধীনে থেকে আদালত শাস্তি দেবার আদেশ দিতে পারে এবং তা কার্যকর করবার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। কোন নাগরিককে আদালতে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা তার মর্যাদা ক্ষূন্ন করা। বিচারকরা আদালতকে শাস্তি দেবার ক্ষেত্র হিসাবে পরিণত করতে পারেন কিনা। তাহলে তো পুরা কারাগারই আদালতে স্থাপন করা যেতে পারে, কিম্বা কারাগারকেই আদালত বানিয়ে ফেলা যায়। তাই না?

৫. আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: আদালতের কাজ হচ্ছে বিচার করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আদালত কি ক্ষমা করতে পারে? সেই সাংবিধানিক ক্ষমতা সার্বভৌমত্বের ধারক ও প্রতীক হিসাবে প্রেসিডেন্ট পারেন, কিন্তুই আদালত যদি কাউকে ক্ষমা করে সেটা কি ন্যায়বিচারের পরিপন্থি নয়?

ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, রায়ের পর আদালতকে বলেছিলেন তিনি আপিল করবেন। সে জন্য তিনি রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালত স্থগিত করেন নি। তিনি বলেছেন, “রায়ের বিরুদ্ধে আমি আপিল বিভাগে আপিল করব। আপিল আমার পক্ষে এলে আদালত কি আমার জীবনের এক ঘণ্টা সময় ফিরিয়ে দিতে পারবেন? নাকি তারা কাঠগড়ায় উঠে এক ঘণ্টা সাজা ভোগ করবেন? আমি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দেব না। আমি আশা করি, আপিল বিভাগের রায় ন্যায়বিচারের পক্ষে যাবে”।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধু্রী নিজের জন্য লড়ছেন না, তিনি লড়ছেন আমদের সকলের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের জন্য। আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে আইন ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত গুরুতর প্রশ্নগুলো তোলা এবং তা মীমাংসার জন্য পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা। তার জন্য দরকার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যেমন দরকার তেমনি নিশ্চিত করা দরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা।