বিএনপি

বিএনপির আত্মঘাতি কৌশল!

১.
গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটি ফ্যাসিবাদী বয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মূলে ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ইসলামোফোবিয়া ও মুসলমানদের উপর দমন পীড়ন। কথায় কথায় রাজাকার বলা, জামায়াত-শিবির বলে হত্যাযোগ্য করা, দাড়ি-টুপিকে কটাক্ষ করা ছিল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রকল্প। বিএনপি এতদিন এসবের বিরোধিতা করে রাজনীতি করেছে। কিন্তু আজ তারা এই বয়ানকেই কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে বসেছে, যা আদর্শগত আত্মঘাত। গত পনেরো বছরের নিজের রাজনীতি নালিফাই করে দেয়া হলো। যার উপর ভিত্তি করে বিএনপি সবচেয়ে বড়দল। এই বিশাল জনসমর্থনের এখন কী হবে? তারা কিসের উপর ভিত্তি করে বিএনপিকে সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখবে?
২.
বর্তমানে যারা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের ৯৫%–এরও বেশি ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণকারী প্রজন্ম। ইতিহাস বলে, ১৯৭০ সালে জামায়াত মাত্র ১% ভোট পেয়েছিল, অথচ আজ বিভিন্ন জরিপে তাদের জনপ্রিয়তা ২৫%-এর ঘরে। অর্থাৎ, ‘রাজাকার’ বলায় জনসমর্থন কমেনি, বরং ভারত বিরোধী অবস্থান ও অন্যায়ভাবে দমন-পীড়নই তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। পক্ষান্তরে, রাজাকারের তালিকায় বিএনপির বহু নেতা থাকা এবং তাদের বংশধরদের এখনও দলে প্রভাব থাকা, একে নৈতিকভাবে বিব্রত করছে। এতে দলটি ভিতর থেকেই দুর্বল হবে।
৩.
এই অবস্থায় বিএনপি হয়তো পুরনো ইসলামপন্থী ও ডানপন্থী মিত্রদের বাদ দিয়ে লেফ্ট বা সেন্টার-লেফ্ট শক্তিকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে। কিন্তু এরা বিএনপির সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়; বরং এদের অনেকেই চায় বিএনপি ধ্বংস হোক। এতে দলীয় তৃণমূল ও কোর ভোটব্যাংকে সংকট দেখা দেবে।
৪.
যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে বিএনপি তার ঐতিহ্যগত কেন্দ্রীয় (সেন্টার) অবস্থান হারিয়ে বামঘেঁষা দল হয়ে উঠবে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে এমন নতুন দলগুলো কাজ করছে। বিশেষ করে এনসিপি ও আপ-বাংলাদেশ, যারা ক্রমে সেন্টার রাজনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছে। বিএনপি এই জায়গাটা হারিয়ে ফেললে কামবেক করা কঠিন হবে।
৫.
জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন এখন সামাজিক দিকগুলোকে তুলে আনছে— যেমন চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়। আর বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলো আটকে আছে পুরনো রাজনৈতিক স্লোগানে— “জামায়াত-শিবির রাজাকার”, “চরমোনাই হুজুর মিথ্যাবাদী” “ একটা একটা শিবির ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর” ইত্যাদি। এই স্লোগানগুলোর সামাজিক প্রভাব কী? কেউ রাজাকার হওয়া না হওয়া নিয়ে দেশের আপামর মানুষের কোনো ক্ষতি হয়? অথচ সারাদেশে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির কারণে ব্যক্তি মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে (যার সাথে বিএনপি’র প্রকৃত নেতাকর্মীরা জড়িত নয় বলেই মনে হয়)। এমতাবস্থায়, জামায়াত, এনসিপির সামাজিক ইস্যুগুলোর ভিত্তিতে অভিযোগগুলো খন্ডন করতে না পারলে এইসব রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে সামাজিক ইস্যু ঢাকা কঠিন হবে। সামাজিক সমস্যা নিয়ে শুধুই রাজনৈতিকভাবে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করলে সুফল আসবে না।
৬.
বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসতে চায়, তবে তাকে নির্বাচনে যেতে হবে। আর সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলের অংশগ্রহণের উপর। অথচ বিএনপি একের পর এক এদের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
ভারতের মতো কোনো শক্তি বিএনপিকে একচেটিয়া সমর্থন দিবে না। বিএনপির ডেডিকেটেড নেতাকর্মীর ঘাটতি রয়েছে, বুদ্ধিজীবিদের অধিকাংশ ডান-বামের। অতএব, সেন্টার টু রাইট সব পক্ষকে শত্রু বানিয়ে সামনে এগোনো আত্মঘাতী কৌশল। কারণ বিএনপি এই ঘরানারই দল। এই সকল পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করে সামনে এগোতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। ২০২৪ বাংলাদেশে এক বড় পরিববর্তন এনে দিয়েছে। একে বিএনপি ধরে রাখতে না পারলে অন্যরা ধরে রাখবে। ২০২৪ হারিয়ে যাবেনা। ধন্যবাদ।
Scroll to Top