আর কত গুম বিচারবহির্ভূত হত্যা

26

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে গত ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকের সশস্ত্র ব্যক্তিরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না। পুলিশের পাঁচ শাখা হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছে, সালাহউদ্দিনের খোঁজ তারা জানে না। পুলিশ তাকে গ্রেফতার বা আটক করেনি এবং তিনি তাদের হেফাজতেও নেই। সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ হন্যে হয়ে খুঁজছেন স্বামীকে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। এক অজানা শঙ্কায় কাটছে তার প্রতিটি মুহূর্ত।

স্বামীর খোঁজে তিনি প্রথমেই ছুটে যান গুলশান থানায়। সেখানে সাধারণ ডায়েরি করতে চাইলে গুলশান পুলিশ তাকে পাঠিয়ে দেয় উত্তরা থানায়। কিন্তু উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশও অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে এবং বলে তিনি নাকি একটি ভাসমান খবর নিয়ে থানায় এসেছেন। এরপর স্বামীর সন্ধান চেয়ে তিনি হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট তার রিটটি গ্রহণ করে ডিবি, এসবি, সিআইডি, র‌্যাব ও মহানগর পুলিশকে ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমদের সন্ধান জানাতে রুল ইস্যু করেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে পুলিশের পাঁচ শাখা থেকে আদালতকে জানানো হয় যে, সালাহউদ্দিনের সন্ধান তারা জানে না। অবশ্য পুলিশ তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে জানায়। হাইকোর্ট এ বিষয়ে আগামী ৮ এপ্রিল আবারো শুনানির দিন ধার্য রেখেছে।

অসহায় হাসিনা আহমদ পরিবারপরিজন নিয়ে দেখা করতে যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়াও দলের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার গুম হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন। হাইকোর্টের দেয়া রুলের শুনানি ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি আছে। তাই নিরুপায় হয়ে হাসিনা আহমদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করার সময় চেয়ে এবং তার স্বামীকে খুঁজে বের করতে ‘বিশেষ নির্দেশনা’ দেয়ার আবেদন করে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। গণমাধ্যমের কাছেও তিনি আকুতি জানিয়েছেন।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্টেও সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরাই সালাহউদ্দিন আহমেদকে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩ বি নম্বর সড়কের ৪৯বি নম্বর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। এই বাড়িতে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন। পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উত্তরার যে বাড়ি থেকে তাকে তুলে নেয়া হয়, সে বাড়ির কেয়ারটেকার, দারোয়ান, কাজের লোক, ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির নিয়োগ করা নিরাপত্তা কর্মী, আনসার এবং আশপাশের বাড়ির প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য নেয়া হয়। তাদের বক্তব্যে এসেছে যে, ডিবি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
পরিচয়ে সাদা পোশাকের সশস্ত্র ব্যক্তিরা একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় গামছা দিয়ে তার চোখ বাঁধা ছিল। পরনে ছিল লুঙ্গি। নিরাপত্তা কর্মী আখতারুল ইসলাম প্রথম আলোকে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে বেশ কয়েকটি গাড়ি নিয়ে একদল লোক সালাহউদ্দিনের বাসায় আসে। বাসার সামনে তিনটি গাড়ি ছিল। কিছুক্ষণ পর রাত ১০টা নাগাদ তারা এসে বলেন, আমরা ডিবির লোক। পকেট গেট দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লে আখতার
জিজ্ঞেস করেন, কি কারণে এসেছেন? তারা বলেন, পরে জানতে পারবি। এ সময় দু’জন তাকে চড়থাপ্পর দেয়। পিস্তল দেখে ভয় পায় আখতারুল। পরে চোখ বাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিনকে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়।

সালাহউদ্দিন আহমেদ খুব অমায়িক, খুব সজ্জন এক মানুষ। তার মধ্যে একজন ভালো মানুষের সব গুণই রয়েছে। যেমন মেধাবী, তেমনি সৎ, কর্মঠ এবং রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি খুবই কমিটেড তিনি। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হিসেবেও সবার কাছে সালাহউদ্দিনের একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে। আত্মগোপনে থেকে বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে তিনি যে কয়টি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন সেগুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যাবে সেখানে দৃঢ়তার সাথে রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, কোনো নোংরামি নেই। দলের নির্দেশনাই তিনি তুলে ধরেছেন। তার স্ত্রী হাসিনা আহমদ যথার্থই
বলেছেন, ‘আমার স্বামী যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন বা তার বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা থাকে, তাহলে তাকে অবিলম্বে আদালতে সোপর্দ করে আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ বিচারকার্যক্রম গ্রহণ করুন। এভাবে নিখোঁজ করে রাখায় অজানা আতঙ্কে আছি যে, ওনার কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়। তাকে কোথায় নেয়া হলো, এখন কী অবস্থায় আছেন, এসব বিষয়ে কেউ ন্যূনতম তথ্যও দিতে পারছে না। চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি কী করব, কী জবাব দেবো ওদের, জানি না।’

সালাহউদ্দিনের গুম বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে সর্বমহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ সরকারের কাছে অবিলম্বে তার সন্ধান চেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে তাকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, তার গুমের ঘটনায় একটি গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। আর এই তদন্ত দ্রুত হওয়া দরকার। ৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা অনেক দেরি হয়ে যাবে।

নির্বিকার রাষ্ট্র
এত উদ্বেগ সত্ত্বেও সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম নিয়ে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ নির্বিকার। এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যাকে নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছুই বলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে বলেন, ‘সালাহউদ্দিন কোথায় তার জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারেন। আন্ডারগ্রাউণ্ডে থেকে তিনি বিবৃতি দিতেন। সবাই জানে তিনি ওখান থেকে (খালেদা জিয়ার কার্যালয়) বিবৃতি দিয়েছেন। আট বস্তা ময়লার সাথে তাকেও কোথায় পাচার করে দিয়েছেন কি না, সে জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারেন।’ স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে, নাকি তিনি নিজেই আত্মগোপনে কোথাও গেছেন- বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট নয়। নাটকও হতে পারে। উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও বলেছেন, একই কথা- ‘সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে ছিলেন এবং আবারো গেছেন।’ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘সালাহউদ্দিন গভীর আত্মগোপনে গেছেন।’ রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয় তাহলে নাগরিকরা যাবে কোথায়? সালাহউদ্দিনকে উদ্ধারের দায়িত্ব সরকারের। উল্টো সরকার এ ধরনের পরিহাস করে চলেছে। এটা বেদনাদায়কই নয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করারও শামিল। এমন তৎপরতা নাগরিক উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৬ মার্চ যে বিবৃতি দেয় তাতে সংস্থাটির পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘বাংলাদেশে গুমের অনেক ঘটনার প্রমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার এসব গুমের কোনো তদন্ত করেনি। গুমের সাথে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে ধরা হয়নি। সালাহউদ্দিন গুমের ঘটনা একটি বিস্তৃত প্রবণতার অংশ। দুর্ভাগ্যক্রমে এ বিষয়ে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে সরকারের অস্বীকৃতি এবং কার্যকর তদন্তে অনীহা প্রকাশও সেই একই প্রবণতার
অংশ।’

আর কত গুম
বাংলাদেশ পরিণত এক গুমরাজ্যে! বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক গুম আর গুপ্ত হত্যার ঘটনায় মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে ৫৩জন গুমের শিকার হন। এর মধ্যে দু’জনের লাশ পাওয়া যায় এবং ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বাকি ৩৩ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালে গুম হন ৩৯ জন। এর মধ্যে ১০ জনের লাশ পাওয়া যায় এবং ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বাকি ১১ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১ জন গুম হন। এর মধ্যে পাঁচজনের লাশ ও ১০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বাকি ছয়জনের কোনো হদিস নেই। অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১১৩ জন গুম হন। এর মধ্যে গুপ্তহত্যার শিকার হন ১৭ জন, জীবিত উদ্ধার হন ৪৬ জন। বাকি ৫০ জনের কোনো হদিস নেই। গত দু’মাসে ৩৬ জন গুম হওয়ার তথ্য এসেছে ১৮ মার্চ যুগান্তরের রিপোর্টে।

বিএনপির তরুণ প্রজন্মের নেতা ইলিয়াস আলী, আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং বিএনপি মহানগর নেতা ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের গুমের ঘটনায় দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ঢাকা সফরকালে বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার আমিনুল ইসলাম ও ইলিয়াস আলীর গুমের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। গুমের পর নিহত আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের। তাদের ভাগ্যে যে কী ঘটেছে কেউ তা জানে না। ২০১২ সালের ১৭ জুন গুম হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী। আগামী ১৭ জুন তার গুম হওয়ার তিন বছর পূর্ণ হবে। স্ত্রী তাহমিনা রুশদী এবং ছেলেমেয়েরা এখনো তার পথ চেয়ে আছেন। কিন্তু তারা জানেন না ইলিয়াস আলী আর কোনো দিন তাদের কাছে ফিরে আসবেন কি না। ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনায় তার স্ত্রীও সালাহউদ্দিনের স্ত্রীর মতো আদালতে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট কেন তাকে আদালতে হাজির করা হবে না মর্মে রুলও দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন ৪৮ ঘণ্টা অন্তর দাখিল
করতে পুলিশকে নির্দেশও দিয়েছিলে মহানগর আদালত। কিন্তু বাস্তবে তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। ইলিয়াসের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো ফল হয়নি।২০১০ সালের জুন মাসে সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম হন চৌধুরী আলম। আগামী জুন মাসে তার গুম হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। তার পরিবারও জানে না তিনি বেঁচে আছেন না লাশ হয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে ইলিয়াস আলী গুম হওয়া পর্যন্ত ১২২ জন গুমের শিকার হন। বাংলাদেশে যতগুলো গুমের ঘটনা ঘেটেছে, তার প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে সাদা পোশাকধারীরাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী এবং সর্বশেষ সালাহউদ্দিন আহমেদের ক্ষেত্রে একই ধরনের বর্ণনা পাওয়া গেছে।

আর কত বিচারবহির্ভূত হত্যা
১৯ মার্চ যশোর সদর উপজেলার সাতমাইল এলাকায় রেললাইনের পাশে যুবদল নেতা ও মনিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউপি সদস্য মেজবাহ উদ্দিন চন্টুর লাশ পড়েছিল। স্বজনদের অভিযোগ তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার। পুলিশ ঢাকা থেকে তাকে আটক করে নিয়ে গিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে হত্যা করেছে। পরে লাশ রেললাইনের পাশে ফেলে রাখে। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা এখন এক বিভীষিকার নাম। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে ফ্রি স্ট্রাইলে চলছে পুলিশ-র‌্যাবের এই
বিচারবহির্ভূত হত্যা। গড়ে প্রতিদিন দু’জন এবং কোনো কোনো দিন চার-পাঁচজনও এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। এর বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত তথা বিরোধী দলের নেতাকর্মী। দৈনিক যুগান্তরে ১৮ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি পর ক্রসফায়ার, গুলিবিদ্ধ, গণপিটুনি ও ট্রাক চাপায় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ৬৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। তবে ১ মার্চ প্রকাশিত মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি থেকে
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৫১ জন কথিত ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসেই ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়।

র‌্যাব পুলিশ এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে কখনো ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, কখনো শুটআউট, এনকাউন্টার বলে আখ্যায়িত করছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘সড়ক বা রেল দুর্ঘটনা’ কিংবা ‘গণপিটুনি’তে মৃত বলেও চালিয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘বাংলাদেশে সহিংসতা দমনে সরকার নির্বিচারে গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ ও গুমের পথ বেছে নিয়েছে।’ বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে
দেশে-বিদেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে জোরালো প্রতিবাদ উঠেছে। এসব প্রতিবাদে বলা হয়, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার ইত্যাদি গোপন মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে, গল্প তৈরি করে মানুষের প্রাণসংহার করা কখনো আইন রক্ষার কৌশল হতে পারে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক এ কর্মকাণ্ড থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনো ক্ষেত্রেই বিচারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়নি। উপরন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিরা এমন সব কথা বলছেন, যেগুলো আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি হুমকি বলেই মনে হয়। পুলিশের আইজি যখন বলেন, ‘যে পুলিশের গুলিতে নিহত হবে, সে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী।’ তখন এই আশঙ্কাই সত্য মনে হয় যে, শক্তি প্রয়োগের এই পদ্ধতি সরকার অব্যাহত রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার এক দিকে বলছে দেশে আইনের শাসন আছে, অন্য দিকে সাধারণ একজন পুলিশ সদস্য আইনের বলে প্রাপ্ত অস্ত্র ও ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার করছেন। মানবাধিকার রক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যদি সন্ত্রাসীদের কায়দায় কাজ করেন, তখন আইন, মানবতা ও আস্থা একত্রে বিনাশ হয়। আর এই সময়টি চিহ্নিত হয় মানবাধিকার দমনের কালো অধ্যায় হিসেবে। ইতোমধ্যে লক্ষ করা গেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও মনোযোগের বিষয় হয়ে আছে। লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনেও
বাংলাদেশের শোচনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনের কেন্দ্র ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হত্যা, নির্যাতন, গুমের বিষয়। অ্যামনেস্টি ২০১৪ সালে গুম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হেফাজতে মৃত্যু ও তথাকথিত ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধের ব্যাপকতাকে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের আইন সালিস কেন্দ্রও গত নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা দমনের পথে ১২৮ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান দিয়েছিল। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনাস্থাই কেবল প্রকাশ পাচ্ছে না, বাহিনীগুলো নিজেদেরকে যে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছে তাই প্রকাশ পাচ্ছে। এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব