হাঁপানির নতুন চিকিৎসা

44

হাঁপানি একটি শ্বাসকষ্টজনিত বক্ষব্যাধি। এখন পর্যন্ত এই রোগের কোনো আরোগ্যদানকারী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগের মতো এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হয়। তাই ভুক্তভোগী রোগীদের প্রত্যাশা করে সেই দিন কবে আসবে, যেদিন ওষুধের মাধ্যমে হাঁপানির যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। সেই আশা পূরণ করার জন্য বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আবিষ্কৃৃত হয়েছে জেফিরলুকাস্ট নামে ওষুধ। একেক দেশে একেক নামে এটি বাজারজাত করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশের বাজারে এসেছে সিঙ্গল এয়ার নামে ১০ মিলিগ্রামের একটি ওষুধ।

এ কথা এখন প্রমাণিত সত্য যে, হাঁপানি রোগের ভিত্তি হলো শ্বাসনালীতে প্রদাহ। এই প্রদাহ সৃষ্টিতে লিউকোট্রাইন নামে একটি পদার্থ রয়েছে, যার ভূমিকা ব্যাপক। লিউকোট্রাইনের কার্যকলাপের ফলেই শ্বাসনালীতে বাধা, সংবেদনশীলতা এবং প্রদাহজনিত রস তৈরি হয়। নতুন ও পুরনো হাঁপানি এই লিউকোট্রাইনবিরোধী হিসেবে অবস্থান নিতে পারে। যদিও আগে এ ধরনের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে তবুও জেরিফরলুকাস্ট ওষুধ লিউকোট্রাইনবিরোধী শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম। অনেকে ইনহেলার ব্যবহার পছন্দ করেন না। অথচ এই ওষুধটি মুখে সেবনযোগ্য। যদিও এই ওষুধটির প্রধান কাজ হাঁপানি প্রতিরোধ; তবুও দেখা যায় হাঁপানি চিকিৎসায়ও এটি বেশ ভালো কাজ করে।

একটি লিউকোট্রাইনবিরোধী ওষুধের কার্যকারিতা হলো প্রাথমিক এবং শেষপর্যায়ের অর্থাৎ উভয় স্তরেই প্রদাহকে সামনাসামনি করা। তাই দেখা গেছে, জিফিরলুকাস্ট ৪০ মিলিগ্রাম ওষুধ একসাথে মুখে সেবন করার পর কার্যকরভাবে শ্বাসনালীর প্রাথমিক এবং শেষপর্যায়ের শ্বাসনালীর সরু হয়ে যাওয়াকে কার্যকরভাবে বাধা দিয়েছে। রোগীর শ্বাসনালী সরু হয়ে থাকে অ্যালার্জি-জাতীয় পদার্থ নাক দিয়ে প্রবেশ করার ফলে। জেফিরলুকাস্টের দক্ষতা বোঝা গেছে এফইভির (১ সেকেন্ডে) ব্যাপক বৃদ্ধি হিসাব করে।
হাঁপানি রোগীদের বেলায় দেখা গেছে যে, কোনো অ্যালার্জি যেমন সালফার-ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে শ্বাসনালীতে ব্যাপক সংবেদনশীলতা দেখা দেয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ মিলিগ্রামের একটি বড়িতেই সালফার-ডাই-অক্সাইডের শক্তিকে অনেক কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

এখন বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইডের ব্যাপক আধিক্য। জেফিরলুকাস্ট ৪০ মিলিগ্রাম সেবনের পর শ্বাসনালীর সংবেদনশীলতাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। অনেক হাঁপানি রোগী আছে, যারা একটু ঠাণ্ডার সংস্পর্শে এলেই তাদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এমনকি ঠাণ্ডা বাতাসেও তাদের শ্বাসকষ্ট বাড়ে। কারণ ঠাণ্ডাতে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায় জেফিরলুকাস্ট আগে খেয়ে নিলে ঠাণ্ডার পরশেও শ্বাসকষ্ট দেখা যায় না।

বেশির ভাগ হাঁপানি রোগীই একটু ব্যায়াম করলেই শ্বাসকষ্টের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়, যাকে বলা হয় ব্যায়ামজনিত বা পরিশ্রমজনিত হাঁপানি। যদিও এই ব্যায়ামজনিত হাঁপানির কারণ জানা যায়নি; তবুও ধারণা করা হয় যে, শ্বাসনালীর ঝিল্লির দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া অথবা দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া। যার ফলে মাস্ট সেলগুলোর কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়।

জেফিরলুকাস্ট এই ব্যায়ামজনিত হাঁপানিতে কোনো ভূমিকা রাখে কি না এ ব্যাপারে গবেষণা হয়েছে। আটজন হাঁপানি রোগীকে ২০ মিলিগ্রামের জেফিরলুকাস্ট একটি বড়ি খাওয়ানো হয়েছিল ব্যায়ামের ২ ঘণ্টা আগে। প্রত্যেক রোগী ৬ মিনিট ব্যায়াম করেছিল বিদ্যুৎচালিত ট্রেডমিলে এবং স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায়। ব্যায়ামের ৩০ মিনিট পর দেখা গেছে, তাদের লাঙ্গ ফ্যাংশন টেস্ট ঠিকই রয়েছে এবং হাঁপানির আক্রমণ দেখা যায়নি।

হাঁপানি চিকিৎসায় সোডিয়াম ক্রোমগ্লাইকেটও কার্যকর এবং প্রচলিত ওষুধ। এ ওষুধটিকে হাঁপানি প্রতিরোধের জন্য আমরা লিখে থাকি। একটি ট্রায়ালে দেখা যায়, ২৮৭ জন রোগীর ওপর জেফিরলুকাস্ট ও সোডিয়াম ক্রোমাগ্লাইকেট ব্যবহার করা হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের হাঁপানি রোগী ছিল। ২৮৭ জনের মধ্যে কোনো কোনো রোগীকে জেফিরলুকাস্ট ২০ মিলিগ্রাম দৈনিক দুইবার করে দেয়া হয়েছে এবং বাকি রোগীদের সোডিয়াম ক্রোমগ্লাইকেট দুই পাফ করে দৈনিক চারবার দেয়া হয়েছে। রোগীদের মধ্যে তাদেরই সুস্থ বলা হয়েছে যাদের দিনের বেলার শ্বাসকষ্ট, রাতে ঘুম ভাঙা ৫০ শতাংশ কমেছে শ্বাসনালী প্রসারক ওষুধের মাত্রা না বাড়িয়েই। এসব ব্যাপার চিন্তা করে দেখা গেছে, জেফিরলুকাস্ট ও সোডিয়াম ক্রোমগ্লাইকেটের মধ্যে কার্যকারিতার দিক দিয়ে খুব একটা পার্থক্য নেই।

সব ওষুধের মতো জেফিরলুকাস্টেরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমনÑ মাথাব্যথা, পেটে অশান্তি, গলায় ফ্যারিনজাইটিস এবং নাক দিয়ে পানি পড়া। এ ছাড়া লিভার ফাংশন পরীক্ষা বিশেষ করে এসজিপিটি মাঝে মধ্যে দেখা প্রয়োজন।

পরিশেষে বলা যায়, জেফিরলুকাস্ট সব ধরনের হাঁপানিতেই কার্যকর। তবে অনেক দিন ধরে সেবন করলে এর কার্যকারিতা ভালোভাবে বোঝা যায়। এই ওষুধটির লিউকোট্রাইনবিরোধী শক্তির জন্য হাঁপানি চিকিৎসার পাশাপাশি অ্যালার্জিজনিত নাকের প্রদাহ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, এসএলই ও রিউআটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগেও এটা ব্যবহার করা যায়। যেহেতু অনেক রোগী ইনহেলারকে একটা ঝামেলা মনে করেন, তাদের সুবিধার জন্য এই ওষুধটি দৈনিক দ্ইুবার করে সেবন করলে হাঁপানি প্রতিরোধের সাথে সাথে হাঁপানির কষ্ট থেকেও মুক্তি লাভ করা যায়। মুখে খাবার থিওফাইলিন এবং স্টেরয়েড ইনহেলার ব্যবহার করে একটি ট্রায়ালে দেখা গেছে যে, মুখে ওষুধ খাবার রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ অথচ ইনহেলার গ্রহণকারীর সংখ্যা ৫৭ শতাংশ।

সেসব কথা পর্যালোচনা করলে আজকাল হাঁপানির চিকিৎসায় আমরা জেফিরলুকাস্টকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। তবে এই ওষুধটি যাতে কখনোই কোনো হাতুড়ে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে না থাকে।
লেখক : অধ্যাপক, এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ। মোবাইল : ০১৭৪৫৯১৯৬৬৪