বাড়ছে যৌনবাহিত রোগ

67

images-2ডা. সুব্রত ঘোষ :: বর্তমান বিশ্বে যে সমস্ত যৌনবাহিত রোগব্যাধি সভ্যতাকে হুমকির মধ্যে রেখেছে তার মধ্যে এইডস অন্যতম। এর সম্পূর্ণ চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এইডসের কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা না থাকায়, মানুষের আচরণগত পরিবর্তনই এর অন্যতম প্রতিরোধক। ব্যাপকভাবে বিস্তার করা যৌনবাহিত আরো দুটি রোগ সিফিলিস ও গনেরিয়া।
যৌনবাহিত রোগ কি?

যে সকল রোগ-ব্যাধি যৌন মিলনের মাধ্যমে অর্থাৎ যৌন পথে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মধ্যে সংক্রমিত হয় তাকেই যৌনবাহিত রোগ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিভিন্ন অনুজীব যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, প্রটোজোয়া ইত্যাদি যৌনবাহিত রোগের জন্য দায়ী।গত কয়েক দশক ধরে যে সকল যৌনবাহিত রোগ আমাদের সমাজে ভয়ঙ্করভাবে বিস্তার লাভ করেছে তাদের মধ্যে এইডস, সিফিলিস ও গনেরিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

যৌনবাহিত রোগ হলে মহিলাদের ক্ষেত্রে কি কি উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

# মহিলাদের যোনি পথে প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত এমনকি পুঁজ বা দইয়ের মতো সাদা স্রাব যায়

# মহিলাদের যোনি পথে চুলকানি বা জ্বালাপোড়া হয়

# সহবাসের সময় ব্যথা হয়

# যৌনাঙ্গে ঘা বা ক্ষত হয়

যৌনবাহিত রোগ হলে পুরুষদের ক্ষেত্রে কি কি উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

# পুরুষদের প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে পুঁজ যায়

# ঘন ঘন প্রস্রাব হয়

# প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং ব্যথা হয়

# অ-কোষে ব্যথা হয় এবং ফুলে যায়

# কুচকির লাসিকাগ্রন্থি ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়

# কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্বরও হয়

যৌনবাহিত রোগ হলে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে?

# অসময়ে প্রসব বা গর্ভপাত হতে পারে

# ডিম্বনালীতে গর্ভধারণ হতে পারে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

# আক্রান্ত গর্ভবতী মা মৃত সন্তান প্রসব করতে পারেন

# সন্তান ধারণে অক্ষমতা বা বন্ধ্যত্ব হতে পারে

# পুরুষদের মুত্রনালী সরু হয়ে যেতে পারে এবং প্রস্রাবের বেগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে

# আক্রান্ত মায়ের নবজাতক শিশুর জন্মগত ত্রুটি ও অন্ধত্ব হতে পারে

# মহিলাদের জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হতে পারে

# এইচআইভি ভাইরাস বা এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে শরীরে একের পর এক নানাবিধ রোগের সংক্রমণ ঘটে যার পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু

# যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়

# স্বামী বা স্ত্রীর যে কেউ যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হলে অপরজনের মধ্যে তা বিস্তারের সম্ভাবনা শতভাগ

সিফিলিস কি?

ট্রিপোনিমা প্যালিডাম (ঞৎবঢ়ড়হবসধ ঢ়ধষষরফঁস) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই যৌনবাহিত রোগটি সংক্রমিত হয়। উপযুক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ফলে রোগটি ভালো হলেও তা শরীরে বহু প্রকার জটিলতার সৃষ্টি করে এবং সামাজিক মর্যাদা আর লোক লজ্জার ভয়ে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাও বাধাগ্রস্ত হয়।

সিফিলিস যেভাবে ছড়ায়

# অবৈধ ও অনিরাপদ যৌন মিলনের মাধ্যমে

# অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে

# ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে

# সিফিলিস আক্রান্ত মা হতে গর্ভাস্থ সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে

# চামড়ার ক্ষত থেকেও সিফিলিস ছড়াতে পারে

# সিফিলিস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে চুম্বনের মাধ্যমেও রোগটি সংক্রমিত হতে পারে

গনেরিয়া কি?

নিশেরিয়া গনোরি (ঘবরংংবৎরধ মড়হড়ৎৎযড়বধব) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই যৌনবাহিত রোগটি আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। উপযুক্ত ও চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটির আরোগ্য সম্ভব হলেও তা দেহে নানা প্রকার মারাত্মক জটিলতার জন্ম দেয় এবং সামাজিকভারে হেয় হওয়ার আতঙ্কে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাও খুব বেশি সহজতর নয়।

গনেরিয়া যেভাবে ছড়ায়

# অবৈধ ও অনিরাপদ যৌন মিলনের মাধ্যমে

# অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে

# ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে

# সিফিলিস আক্রান্ত মা হতে গর্ভস্থ সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে

# চামড়ার ক্ষতস্থান থেকে নির্গত রস ও পুঁজ থেকেও সিফিলিস ছড়াতে পারে

এইচআইভি ও এইডস কি?

ঐওঠ এর অর্থ :

ঐ = ঐঁসধহ (মানুষ)

ও = ওসসঁহড়ফবভরপরবহপু (দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব)

ঠ = ঠরৎঁং (এক প্রকার জীবাণু)

এইচআইভি হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাস মানবদেহে রোগ প্রতিরোধকারী কোষসমূহকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে মানুষ তার শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বিভিন্ন রোগে আত্রান্ত হয়ে এক পর্যায়ে মারা যায়।

অওউঝ এর অর্থ :

অ = অয়ঁরৎবফ (অর্জিত)

ও = ওসসঁহব (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা)

উ = উবভরপরবহপু (অভাব)

ঝ = ঝুহফৎড়সব (লক্ষণসমূহ)

এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের পরিণতি এইডস। বিভিন্ন জীবাণুর হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতা শরীরে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে শরীরকে নানাবিধ রোগ-ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করে। এইচআইভি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে দেয়। তখন শরীর প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে একজন ব্যক্তি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তার শরীরে নানা রকম রোগের লক্ষণ দেখা দেয়Ñ এই অবস্থাকেই এইডস বলা হয়।

এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার পর বহু বছর পর্যন্ত মানুষের শরীরে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ নাও পেতে পারে। সাধারণত এইচআইভি সংক্রমণের পর বিভিন্ন প্রকার রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই সময়ের ব্যবধান ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে।

যেভাবে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে :

# অবৈধ যৌন মিলনের মাধ্যমে

# অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে

# ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে

# এইচআইভি আক্রান্ত মা হতে গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় অথবা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে সন্তানও এইচআইভি আক্রান্ত হতে পারে

# অনিরাপদ যৌন মিলন এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়

যেভাবে এইচআইভি সংক্রমিত হয় না :

# আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত থালা-বাসন, গ্লাস, প্লেট ইত্যাদি ব্যবহার করলে বা একই পাত্রে খাবার খেলে।

# আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা, করমর্দন, কোলাকুলি, খেলাধুলা, স্পর্শ করলে এবং একই বিছানা ব্যবহার করলে।

# আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা থুথুর মাধ্যমে

# মশা-মাছির মাধ্যমে

# একই বাথরুম-ল্যাট্রিন ব্যবহার করলে

# আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে একই পুকুরে গোসল করলে

# এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি বা এইডস রোগীর সেবা করলে

এউডস থেকে নিরাপদ থাকার উপায়

# পুরোপুরি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা

# স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা

# রক্ত গ্রহণের পূর্বে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নেয়া

# প্রতি ক্ষেত্রে ইনজেকশন নেয়ার সময় নতুন সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করা

# এইচআইভি আক্রান্ত মায়েদের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান ধারণে সিদ্ধান্ত নেয়া

বয়স, শারীরিক ও আবেগগত বিকাশ এবং আর্থিক নির্ভরতাসহ নানাবিধ কারণে এই অল্পবয়সী জনগোষ্ঠী এইচআইভি ও এইডস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুব সমাজ এইচআইভি প্রতিরোধ ও এইডস সংক্রান্ত তথ্য, সেবা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বব্যপী আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষাজনিত কারণ কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের এইচআইভি ও এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে এইচআইভি ও এইডস পরিস্থিতি

সার্বিকভাবে বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার যদিও কম, কিন্তু এ সংক্রমণের জন্য দায়ী সকল ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। তাই এ দেশে যে কোনো সময় এইচআইভি ও এইডস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। আমাদের যুবসমাজ, অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ এইডসের ভয়াবহতার শিকার হতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি সংক্রমতি ব্যক্তি শনাক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালে। সেই থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শনাক্তকৃত এইচআইভি আক্রান্তের সর্বমোট সংখ্যা ২ হাজার ৫১২। এদের মধ্যে ৭৪৫ জন এইডসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৫১২ জন।

যে সব কারণে বাংলাদেশের যুবসমাজ এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে :

# ধর্মীয় অনুশাসন পুরোপুরিভাবে মেনে না চলা

# বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও সতর্কতার অভাব

# এইচআইভি থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা

# দলবদ্ধভাবে একই সুচ-সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে নেশা করা। এতে এক জনের শরীরে এইচআইভি জীবাণু থাকলে সুচের মাধ্যমে দলের অন্য সবার শরীরে ছড়াতে পারে

# আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এইচআইভি ও এইডসের ব্যাপক উপস্থিতি এবং এ সকল দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, মেলামেশা ইত্যাদির কারণে মানুষের ব্যাপক যাতায়াত

# অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের নৈতিক চরিত্র গঠনে পিতা-মাতা কর্তৃক তাদের করণীয় বুঝতে না পারা

# ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেয়া