প্রত্যেকের ঘড়ি আলাদা, মানতে শিখুন

“ওমা, টেনে উঠে গেলি, এখনো শরীর খারাপ হল না কিরে? কুমারী হতে হতে ঠাকুর কি তোকে সারাজীবন কুমারীই রেখে দেবেন?”

54
প্রত্যেকের ঘড়ি আলাদা, মানতে শিখুন

মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমার বয়স ছিল পনেরো বছর কয়েক মাস এবং ওজন ঠিক বত্রিশ কেজি। সুন্দর মডেল টাইপ রোগা নয়, আমি ছিলাম সিরিঙ্গে টাইপ রোগা, এখন হলে হয়ত ‘সাইজ জিরো’ উপাধিতে ভূষিত হতাম। তখনো আমার পিরিয়ডস শুরুই হয়নি, হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে।

একটু আনকমন, তাই না?

কিন্তু সব আনকমন মানেই কি অস্বাভাবিক, প্রতিবন্ধকতা?

আনকমন মানেই কি সমাজ তাকে বিদ্রূপের দৃষ্টিতে দেখার ছাড়পত্র পেয়ে যায়?

আজ বলতে কোনো দ্বিধা নেই, ক্লাস সেভেন এইট থেকে শুরু করে কলেজে ঢোকার আগে পর্যন্ত এই সময়কালটা আমার জীবনের ছিল একটা চাপা ডিপ্রেশনের সময়। বাইরে উচ্ছল থাকলেও ভিতরে একটা চাপা গুমোট কাজ করতো সবসময়।

কিন্তু কেন?

আমি পড়াশুনোয় ভাল ছিলাম, সেই সময়ের টিন এজারদের মধ্যে ক্যুইজের একটা ঢেউ উঠেছিল, পাড়া, অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে জেলাস্তরে ভাল ক্যুইজ করিয়ে হিসেবে আমার বেশ নামডাকও হয়েছিল। নাটক করতাম, লাইব্রেরী যেতাম, লেখালেখিতেও ছোটবড় বেশ কয়েকটা পুরষ্কার জুটেছিল। তবু বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় মহলে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে একটা চাপা হীনমন্যতা কাজ করতে শুরু করেছিলো।

কেন?

কারণ আমার সমসাময়িক মেয়েদের মত আমার শরীরের বিকাশ তখনো ঠিকমতো হয়নি। কারণ আমার বান্ধবীরা যখন চুলে নতুন শোনা লেয়ার, স্টেপ এইসব কাট পরীক্ষা করছে, আমার তখন সোজা সাপটা ঘাড় পর্যন্ত কাটা বয়কাট চুল। বাবার জেন্টস সাইকেল তীরের বেগে চালিয়ে কোচিং ক্লাসে যাই, আড়চোখে হাসা, একটুতেই এ ওর গায়ে ঢলে হেসে গড়িয়ে পড়া মেয়েদের সযত্নে এড়িয়ে চলি, আমাদের মফঃস্বল এলাকায় কেউ তখনকার ভাষায় ‘ঝাড়ি মারতে’ চেষ্টা করলে উদ্ধত চোখে কড়কে দিই, যতটা না তাকে শাস্তি দিতে, তার চেয়ে বেশি সেই কাঁচা বয়সের ওস্তাদি মানে ‘ঘ্যাম’ দেখাতে। গার্লস স্কুলে পড়লেও টিউশন ক্লাসে ছেলেদের সাথেই বেশি মিশি, সেটা কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েদের ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি আমার পোষাত না বলেই। ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে চলি, কেউ সেটাকে অহংকারের প্রকাশ বলে ভুল করে, কেউ আবার ‘অন্য কিছু’।

সেই ‘অন্য কিছু’তেই আমি এবার আসছি।

ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার পরেও যখন আমার পিরিয়ড হল না, আমার অতিশুভানুধ্যায়ী কিছু আত্মীয়া আমার মায়ের কাছে এসে বড়ই চিন্তায় পড়ে গেলেন, ‘একি অস্বাভাবিক ব্যাপার? আশপাশের সব মেয়েগুলো পুইডগার মত তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে, অথচ এর কোনোদিকেই কোনো বৃদ্ধি নেই? চুলটাও বাড়াও না কেন তোমার মেয়ের?’

তাঁদের চেয়েও বেশি চিন্তায় পড়লেন কিছু পাড়া প্রতিবেশী, কেউ কেউ তো সটান বলেই বসলেন মা’কে, “তোমার মেয়ের যেন কোনো লালিত্য নেই! কেমন ছেলে ছেলে ভাব! আচ্ছা এখনো শরীর খারাপ হয়নি, না!”

ক্লাস নাইনে উঠে যেদিন প্রথম শাড়ি পড়ে স্কুলবাসের জন্য বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি, হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এলেন পাড়ার এক বৃদ্ধা জেঠিমা, “তাই বটে! দেখতে এলাম তুই শাড়ি কোথায় পরেছিস! শাড়ি পরার মত তোর আছেটাই বা কি! শেষে টেপজামার ওপর ব্লাউজ?”

সেই মুহূর্তে হেসে লঘু করলেও সেদিনের সেই জেঠিমার চোখের বিশ্রী কৌতুকময় ইঙ্গিতের সাথে বলা কথাগুলোকে কিন্তু রাস্তাঘাটে চোখ দিয়ে নিরন্তর শরীর চেটে চলা, ভিড় বাসে স্পর্শ করা কুতকুতে হাতগুলোর চেয়ে আমার কম অশ্লীল কিছু মনে হয়নি তখন!

নাইন, টেন, সময় যত এগিয়েছে, আমার মধ্যেও সেই চিন্তার নদী ডানা মেলেছে। ‘বডি শেমিং’ আসলে একটা ঘৃণ্য ছোঁয়াচে রোগের মত, একজন থেকে আরেকজনে প্রবাহিত হয়ে চলে খুব সহজে।

আমার যে ছেলেবন্ধুদের সাথে আমি সারাক্ষণ সহজভাবে মিশতাম, তাদের মধ্যের একান্ত ছেলেদের আলোচনায়ও কেউ হয়ত প্রথম প্রস্তাবটা উত্থাপন করে, তারপর বয়ঃসন্ধির কৌতূহলে তারাও আশপাশের দ্রুত প্রজাপতি হতে থাকা বান্ধবীদের মাঝে আমার মত কমনীয়তার ছিটেফোঁটাও না থাকা শুঁয়োপোকাকে দেখতে পেয়ে সেটাকে ভারী সরস একটা বিষয় ভেবে বসতে শুরু করলো, হঠাৎ করেই আমি কেমন বিধর্মী হয়ে গেলাম তাদের মাঝে।

মাঝেমধ্যেই তাদের পরোক্ষ রসিকতায় আমার ঘাটতি বুঝতে পারতাম আমি, কিশোরীবেলার জড়তায় নিজের মধ্যেই নিজে গুটিয়ে যেতাম যেন! শুধু ছেলেরাই কেন, মেয়েরাও তখন নবাগত শারীরিক পরিবর্তনে বিভোর, তারাও সেই আলোচনায় আমাকে দুধুভাতুর চোখেই দেখতো, আমার তেরে নাম মার্কা চুলের দিকে তাকিয়ে তারা চোখ টিপে বলতো, “এই, তুই সত্যিই মেয়ে তো?”

মনে আছে নাইনে পড়তে একদিন সকাল থেকেই মনটা এই নিয়ে মেঘলা হয়ে ছিল, অঙ্ক ক্লাসটেস্টের রেজাল্ট বেরলো, আমি ফুল মার্কস পেয়েও একটুও খুশি না হয়ে সেই দুঃখেই গুমরোচ্ছিলাম।

পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিংবা কোনো সোশ্যাল গ্যাদারিং এ মহিলামহলে অনেকেই আমার শরীর নিয়ে নিরামিষ রসিকতা করতেন, তাদের কাছে সেটা ‘ইয়ার্কি’ হলেও আমার মনে সেটা কতটা বিঁধত, কেউ বোঝেনি।

ছোটবেলায় অনেক জায়গায় মহাষ্টমীর পুজোয় কুমারী হতাম, সেই প্রসঙ্গ টেনে শুনতে হতো, “ওমা, টেনে উঠে গেলি, এখনো শরীর খারাপ হল না কিরে? কুমারী হতে হতে ঠাকুর কি তোকে সারাজীবন কুমারীই রেখে দেবেন?”

বিদ্রূপধর্মী ইঙ্গিত শুনতে শুনতে আমারও মনে হতো, আমি কি সত্যিই স্বাভাবিক নই? তখন ইন্টারনেট ছিল না, বইয়ের নেশা আমার চিরকালই, যেখানে যা বই পেয়েছি, হোমিওপ্যাথি থেকে আয়ুর্বেদ, উল্টেপাল্টে খুঁজতে চেষ্টা করতাম, হাজার মেয়েলি মেয়ের মাঝে আমি নরম্যাল তো?

মাধ্যমিক অবধি মায়ের কাছে ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা আর বাবার কাছে অঙ্ক করতাম। সন্ধ্যেবেলায় মায়ের কাছে বসে সেই বয়সের অভিমানে মা’কে বলতাম আমার দুঃখের কথা, পরীক্ষার সাফল্য, ক্যুইজের ফার্স্ট প্রাইজ, সব যেন তুচ্ছ হয়ে যেতো আমার সেই হীনমন্যতার কাছে।

কিন্তু মা আমার সেই প্যানপ্যানানিতে পাত্তা দেওয়ার লোক নন। প্রথম প্রথম মা ধৈর্য নিয়ে বোঝাতেন, তারপর থেকে আমি ঘ্যানঘেনে স্বরে সেই এক প্রসঙ্গ তুলতে গেলেই এক দাবড়ানি দিতেন, “তোর মাথায় খালি এক চিন্তা না? কতবার বলেছি, সবার সবকিছু একসময়ে হয় না, প্রত্যেকের শরীরের ঘড়ি, মনের ঘড়ি সব আলাদা? তুই রোগা, তাই দেরি হচ্ছে। সব ঠিক সময়ে হবে। ঝামেলা ছাড়া যতদিন থাকা যায়, ততদিনই তো ভাল। যারা যা বলছে, বলতে দে। পড়াশুনো, ক্যুইজ, লেখা নিয়ে থাক। এইসব নেগেটিভ কথা যে বা যারাই বলবে, একদম পাত্তা দিবি না।’

কিন্তু ‘পাত্তা দিবি না’ বললেই যদি পাত্তা না দিয়ে ধ্যানস্থ বিশ্বামিত্র হয়ে থাকা যায়, তবে তো পৃথিবীতে এত কিছু দিনরাত ঘটে চলতো না, দুটো বড় বড় যুদ্ধও হয়ে যেতো না!

আমার সেই মনখারাপের ফেজ কাটতে লেগেছিল আরো বছরদুয়েক। আস্তে আস্তে আমার শরীরেও সেই বহুকাঙ্খিত পরিবর্তন এলো। উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পা রাখলাম, যখন আমার চুল কোমর ছেড়ে হাঁটুর দিকে নামল, সেই রসিকতা করা নিরামিষাশী প্রাণীগুলো হঠাৎ আমাকে অনেকদিন পরে দেখে অবাক হয়ে যেতেন, “ওমা! তুই কত বদলে গেছিস রে! চিনতেই পারিনি! কি রোগা ছিলিস! চুলটা এত বড় হল কি করে?”

তখন আমি আর ভীতু লাজুক মেয়েটি নেই। মৃদু হেসে বলতাম, “সবার ঘড়ি একই টাইম দেয় না জেঠিমা। প্রত্যেকের ঘড়ি আলাদা। সেটা মানতে শিখুন, সেটাকে সম্মান করতে শিখুন।”

কিন্তু জেদের বশে চাঁছাছোলা উত্তর দিলেও কৈশোরের সেই রক্তক্ষরণটাকে ভুলতে পারতাম কি? বরং অনাবশ্যক এবং অপ্রয়োজনীয় রুক্ষতা, ঔদ্ধত্যের আবরণে জড়িয়ে ফেলতে হতো নিজেকে।

নিজের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা এত বিশদে বললাম এই কারণে যে, আবারও বলছি, বডি শেমিং একটা দগদগে, ঘিনঘিনে চর্মরোগের মতই সামাজিক ব্যাধি। আমরা অনায়াসেই ফেসবুকে নামী কমিকশিল্পীর শরীরকে বিদ্রূপ করে ‘এ কার বউ হবে?’ ‘এ অমুকের বর হবে’ ইত্যাদি স্থূল পি জে করে লুটোপুটি খাই, পাশের ছেলে বা মেয়েটাকে ‘পিপের মত মোটা’, ‘বি পি এল’, এইসব আখ্যা দিয়ে হেসে গড়াগড়ি যাই। কিন্তু ভুলেও ভাবিনা যার উদ্দেশ্যে এটা বলা তার কতটা কষ্ট হতে পারে। সেই কষ্ট থেকে, সেই অপমান থেকে সে কি করতে পারে। বেশিরভাগই এর শিকার হয় কিশোর অবস্থায়, যখন মানুষের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ভালমত গড়ে ওঠেনা, সেই হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠার মত মানসিক জোর তো সকলের নাও থাকতে পারে!

বডি শেমিং এর শিকার হয়েছেন অনেকে। সেরেনা উইলিয়ামস, সেলেনা গোমেজ থেকে হালের সোনম কাপুরকে পর্যন্ত শুনতে হয়েছে তাঁর স্তনের আকার নিয়ে। এমনিতেই এখন কাউকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক ‘অকারণ খিল্লি’ কিছু ইন্টেলেকচুয়াল সোশ্যাল মিডিয়া ইউজারদের জাতীয় কর্তব্য। তার উপর এই ব্যাপার হলে তো কথাই নেই, তাঁরা বেমালুম একটা করে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্য কাজে, কিন্তু ভিক্টিম গুমরোতে থাকে।

এই নিয়ে অনায়াসে একটা গল্প লিখতে পারতুম, যাতে অন্তিমে বডি শেমিং এর শিকার হওয়া মেয়েটি বা ছেলেটি হয়ত নাটকীয় সাফল্য পেতো, সবাইকে চুপ করিয়ে দিত যোগ্য জবাব দিয়ে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তা না করে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছে হল, যাতে আমার এই লেখা পড়ে অন্তত একজনও ওইসমস্ত কুরুচিপূর্ণ পোষ্ট বা বিদ্রূপ থেকে বিরত হন।

শুধু যে হাজার হাজার মেয়ে প্রতিনিয়ত এমন বডিশেমিং এর শিকার হচ্ছেন তা কিন্তু নয়, ছেলেরাও হচ্ছেন। কার দাড়ি গজাচ্ছেনা, কার গলার স্বর এখনো কেন পুরুষালী হয়নি।

সময় চলে যায়, কিন্তু তাঁদের সেই মনখারাপের ঘা’টা কিন্তু শুকিয়ে দাগ হয়ে রয়ে যায়।

আসুন আমরা সবাই বড় হই। শরীরে নয়, মনে। প্রত্যেককে সম্মান করতে শিখি, প্রত্যেকের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে শিখি। প্রত্যেকেই নিজের মত করে সুন্দর, নিজের মত করে আকর্ষণীয়, সেটা উপলব্ধি করে শিখি। প্রত্যেকের শরীর, মন, অ্যাচিভমেন্টের ঘড়ি আলাদা, সেটা মানতে শিখি।

এইগুলো ছাড়া সত্যিই কিন্তু শিক্ষা অর্থহীন!

এই লেখাটা বডি শেমিং এর বিরুদ্ধে হলেও এটা পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে তুলনা, বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে তুলনা সবের ক্ষেত্রেই খাটে।

বড়দের ব্যবহারও কিন্তু শিশুদের মধ্যে ছোট থেকে অপরাধ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে একটা ভূমিকা নেয়। যে বাচ্চা ছেলেটা রোজ রাতে বাবার হাতে মা’কে মার খেতে দেখে, সে সেটাকেই স্বাভাবিক ধরে নেয়, এভাবেই জন্ম হয় অনেক রেপিস্ট, ইভ-টিজার বা অন্য ক্রিমিন্যালদের।

অহেতুক বিদ্রূপ করে, তুলনা করে মাটির তালের মত বাচ্চাদের শৈশব, কৈশোরগুলোকে বিষিয়ে না দিয়ে, তাদের সামনেই নিজেদের মধ্যে ‘ইশ ও কি কালো’, ‘ও কি মোটা’ জাতীয় ফিসফাস করে তাদের অবচেতনে এই বডি শেমিং এর বিষ না ঢুকিয়ে আসুন তাদের উৎসাহ দিই, তাদের ইচ্ছেমত ডালপালা মেলে বাড়তে দিই, তারা যদি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ও, নিঃশর্ত ভালবাসার হাতদুটো বাড়িয়ে দিই।

অভিধান থেকে মুছে দিই বডি শেমিং শব্দটি!

সৃষ্টি করি একটা সুন্দর পৃথিবীর !