ঈর্ষা সামলানোর নতুন দর্শন: সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কার্যকর কৌশল

ঈর্ষা সামলানোর নতুন দর্শন: সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কার্যকর কৌশল

মূল বিষয়গুলো

  • প্রায় সব দম্পতিই সম্পর্কের কোনো না কোনো সময়ে ঈর্ষার মুখোমুখি হন, বিশেষ করে সম্পর্কের শুরুতে।
  • ঈর্ষাকে সাধারণত একটি নেতিবাচক আবেগ হিসেবে দেখা হয় যা সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
  • কিছু ক্ষেত্রে ঈর্ষা সহায়ক সংকেত হিসেবেও কাজ করতে পারে।
  • ভারসাম্যপূর্ণভাবে হ্যান্ডেল করা হলে ঈর্ষা আমাদেরকে আরও নিরাপদ সংযোগ গড়তে সাহায্য করতে পারে।

ঈর্ষা হলো রোমান্টিক সম্পর্কের একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ। আসলে, বেশিরভাগ দম্পতিই সম্পর্কের শুরুতে কোনো না কোনো সময়ে ঈর্ষার সম্মুখীন হন। এটি হঠাৎ করেই প্রকাশ পেতে পারে বা ধীরে ধীরে জমতে জমতে সামনে আসতে পারে, যা প্রায়শই টানাপোড়েন, অবিশ্বাস, ও দূরত্ব তৈরি করে।

ঈর্ষাকে সাধারণত নেতিবাচক আবেগ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে এটি একজন মানুষের আবেগীয় চাহিদা এবং সংযুক্তির ধরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়।

দম্পতি-থেরাপিস্ট স্টিভেন স্টসনি, পিএইচডি, যিনি Empowered Love বইয়ের লেখক, তার কাজের ভিত্তিতে আমি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলছি—যাতে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে নিজেদের ভেতরে ঈর্ষাকে চিনতে হয় এবং কীভাবে এটিকে বিকাশ ও সম্পর্কের গভীর সংযোগে রূপান্তর করা যায়।

ঈর্ষার আবেগীয় প্রেক্ষাপট বোঝা

সম্পর্কে আবেগীয় আত্ম-সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। আমরা সাধারণত ভাবি—“আমি ঈর্ষা বোধ করছি কারণ তুমি এমন কিছু করেছ যা আমাকে এইভাবে অনুভব করিয়েছে।” কিন্তু ঈর্ষা সচরাচর শুধু সঙ্গীর আচরণ থেকেই আসে না। বরং এটি সাধারণত ভেতরের ভয় থেকে আসে—যেমন ছেড়ে দেয়া বা হারিয়ে ফেলার ভয়, অযোগ্যতার ভয়, বা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ভয়।

এসব ভয় কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে প্রকাশ পায়—রাগ, দূরত্ব তৈরি, অতিরিক্ত নিশ্চয়তা চাওয়া, কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার আচরণের মাধ্যমে। ঈর্ষা প্রকাশ করতে আমরা অনীহা বোধ করি কারণ এটি দুর্বলতার অনুভূতি জড়িত। ফলে সরাসরি বলার বদলে আমরা প্রশ্ন করি, দূরে সরে যাই, বা সঙ্গীর বন্ধু-বান্ধব বা সামাজিক আচরণ সমালোচনা করি।

এ ধরনের প্রতিক্রিয়া, যা মূলত আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে হয়, কিন্তু তা সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ায় এবং বিশ্বাস নষ্ট করে। সংযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে, তখন আমরা “সম্পর্ক রক্ষা” নয় বরং “আত্মরক্ষা” মোডে চলে যাই।

মূল কারণ চিহ্নিত করা

ঈর্ষার শিকড় প্রায়শই পূর্বের সম্পর্কের ক্ষতগুলোতে থাকে—যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ, মানসিক অবহেলা, বা অতীত সঙ্গীর অসম্মানজনক আচরণ। এসব অভিজ্ঞতা মনে গেঁথে থাকার কারণে আমরা নতুন সম্পর্কেও সেসব স্মৃতির আলোকে ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করি।

স্টসনির মতে, ঈর্ষার উপস্থিতি আসলে সম্পর্কের ভেতরে দূরত্বের ইঙ্গিত দেয়। এবং এটি একটি সংকেত, যাতে আমরা সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা খেয়াল করতে পারি।

শুধু তাই নয়, ঈর্ষাকে আমরা একটি প্রশ্নে পরিণত করতে পারি: এই আবেগটি আমাকে আমার গভীরতর ভয় বা অপূর্ণ চাহিদা সম্পর্কে কী শিখাতে চাইছে?”

সঙ্গীর কাজের দিকে একমাত্র মনোযোগ না দিয়ে বরং ভেতরে তাকানো জরুরি—কোন অংশটি হুমকির মুখে পড়ছে এবং কেন। আমি কি নিজেকে যথেষ্ট মনে করছি না? আমি কি আবেগীয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হওয়ার ভয়ে ভুগছি? আমার কি আত্মমূল্যবোধ কম? এভাবে গভীরভাবে ভাবলে ঈর্ষা প্রতিযোগিতার বিষয় নয় বরং দুর্বলতার স্বীকারোক্তিতে রূপ নেয়।

ঈর্ষা সামলানোর কৌশল

ঈর্ষাকে সম্পর্কের বিকাশের সুযোগে রূপান্তর করতে নিচের কৌশলগুলো কার্যকর হতে পারে—

১. আবেগকে স্পষ্টভাবে নাম দিন:
সরাসরি “আমি ঈর্ষা বোধ করছি” বলা দায় চাপানোর পরিবর্তে স্পষ্টতা ও দায়িত্বশীলতা আনে। ভাবা যেতে পারে—এটি কি আগের কোনো অভিজ্ঞতা থেকে আসা হারানোর ভয় বা বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার ভয়?

২. দুর্বল কিন্তু খোলামেলা আলাপ করুন:
অভিযোগ না এনে অনুভূতিকে বোঝার আহ্বানে রূপ দিন। যেমন:
তুমি ওই সহকর্মীর সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বলার পর আমি একটু অনিরাপদ বা অস্বস্তি বোধ করেছি। আমরা কি এ নিয়ে কথা বলতে পারি?”

৩. আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন:
বিশ্বাস শুধু সম্পর্কের ভেতরে নয়, নিজের ভেতরেও তৈরি করতে হয়। এর মানে হলো নিজেকে বিশ্বাস করা যে আমি অস্বস্তি সামলাতে পারব, কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারব, এবং বাইরের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর না করে নিজের মর্যাদা ধরে রাখতে পারব।

৪. নিজের মূল্যবোধে বিনিয়োগ করুন:
আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান বাড়ায় এমন কাজে যুক্ত হোন। যখন একজন ব্যক্তি নিজের পরিচয় ও মূল্যবোধে দৃঢ় থাকেন, তখন ঈর্ষার প্রভাব অনেকটা কমে যায়।

উপসংহার

ঈর্ষা, যদিও অস্বস্তিকর, কিন্তু নিজে নিজে ক্ষতিকর নয়। এটি সমস্যাজনক হয় তখনই, যখন আমরা হঠাৎ প্রতিক্রিয়া দেখাই বা আবেগ বন্ধ করে দিই। কৌতূহল ও সহানুভূতির সঙ্গে দেখলে ঈর্ষা আসলে ঘনিষ্ঠতা ও ব্যক্তিগত বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

নিজের সঙ্গে এবং সঙ্গীর সঙ্গে আবেগীয় সততা জরুরি। যখন আমরা আবেগের গভীর শিকড় খুঁজে বের করার কৌতূহল নিয়ে ঈর্ষাকে সামলাই, তখন এটি আরও গভীর সংযোগের সুযোগ হয়ে ওঠে। বিশ্বাস গড়ে তোলা, আবেগীয় ট্রিগার বোঝা, এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি করা কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নয়—বরং এটি আসল, দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং নিরাপদ সংযুক্তির পথে অগ্রগতি।

সূত্র:
Stosny, S. (2010, March 9). Disarming the Jealousy Complex. Psychology Today.

 

Scroll to Top