ডার্টমাউথ কলেজের গিসেল স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক মাইকেল হেইঞ্জ এবং নিকোলাস জ্যাকবসনের নেতৃত্বে একটি র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল (আরসিটি) পরিচালিত হয়

মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় এআই ‘থেরাবট’

মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই সংকট মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-ভিত্তিক সমাধান হিসেবে ‘থেরাবট’ নামে একটি উদ্ভাবনী প্রযুক্তি সামনে এসেছে। এই প্রতিবেদনে থেরাবটের কার্যকারিতা, এর প্রভাব, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট এবং সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

থেরাবট কী?

থেরাবট একটি এআই-চালিত ভার্চুয়াল মানসিক স্বাস্থ্য সহকারী, যা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে কথোপকথন করে। এটি কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (সিবিটি)-এর মতো প্রমাণিত কৌশল ব্যবহার করে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং খাওয়ার ব্যাধি মোকাবিলায় সহায়তা করে। থেরাবটের ওয়েবসাইট অনুসারে, এটি ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নিরাপদ, বিচারমুক্ত পরিবেশ তৈরি করে এবং প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (এনএলপি) ব্যবহার করে তাদের আবেগ ও প্রয়োজন বোঝে।

সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল

ডার্টমাউথ কলেজের গিসেল স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক মাইকেল হেইঞ্জ এবং নিকোলাস জ্যাকবসনের নেতৃত্বে একটি র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল (আরসিটি) পরিচালিত হয়, যা NEJM AI-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় ২১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশ নেন, যাদের মধ্যে ১০৬ জন থেরাবট ব্যবহার করেন এবং ১০৪ জন কন্ট্রোল গ্রুপে ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (এমডিডি), জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (জিএডি) এবং খাওয়ার ব্যাধির ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

গবেষণার মূল ফলাফল নিম্নরূপ:

  • বিষণ্ণতা: থেরাবট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিষণ্ণতার উপসর্গ গড়ে ৫১% কমেছে, যা মেজাজ এবং সামগ্রিক সুস্থতায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি এনেছে।

  • উদ্বেগ: উদ্বেগের উপসর্গ গড়ে ৩১% হ্রাস পেয়েছে, অনেকে মাঝারি থেকে হালকা উদ্বেগে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

  • খাওয়ার ব্যাধি: শরীরের চিত্র এবং ওজন নিয়ে উদ্বেগ ১৯% কমেছে, যা কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় উল্লেখযোগ্য।

অংশগ্রহণকারীরা গড়ে ছয় ঘণ্টা থেরাবটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা প্রায় আটটি থেরাপি সেশনের সমতুল্য। তারা প্রায়ই দুঃসময়ে, যেমন মাঝরাতে অনিদ্রার সমস্যা নিয়ে কথোপকথন শুরু করতেন, যা এআই থেরাপির সহজলভ্যতার সুবিধা তুলে ধরে।

বিষয়

উপসর্গ হ্রাস (%)

মন্তব্য

বিষণ্ণতা

৫১%

মেজাজ এবং সুস্থতায় ক্লিনিকালি উল্লেখযোগ্য উন্নতি।

উদ্বেগ

৩১%

মাঝারি থেকে হালকা উদ্বেগে স্থানান্তর, কিছু ক্ষেত্রে ক্লিনিকাল সীমার নিচে।

খাওয়ার ব্যাধি

১৯%

শরীরের চিত্র এবং ওজন নিয়ে উদ্বেগ কমেছে।

থেরাবটের সুবিধা

থেরাবটের উন্নয়ন ২০১৯ সালে ডার্টমাউথের এআই অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ল্যাবে শুরু হয়, যেখানে মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ক্রমাগত পরামর্শ করা হয়। এটি নিম্নলিখিত সুবিধা প্রদান করে:

  • সহজলভ্যতা: ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে সেবা গ্রহণ করা যায়।

  • গোপনীয়তা: ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষিত থাকে এবং তারা বেনামে সেবা নিতে পারেন।

  • সাশ্রয়ীতা: ঐতিহ্যবাহী থেরাপির তুলনায় এটি কম খরচে সেবা প্রদান করে।

  • ব্যক্তিগতকৃত সেবা: এআই ব্যবহারকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী কথোপকথন পরিচালনা করে, যেমন সিবিটি-ভিত্তিক প্রম্পট, মাইন্ডফুলনেস ব্যায়াম এবং সহায়ক বক্তব্য।

  • নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য: থেরাবট উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়বস্তু, যেমন আত্মহত্যার চিন্তা, শনাক্ত করতে পারে এবং ব্যবহারকারীদের জরুরি সহায়তার জন্য ৯১১ বা ক্রাইসিস হটলাইনে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।

এনপিআর-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যবহারকারীরা থেরাবটের সঙ্গে মানুষের থেরাপিস্টের মতোই শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যা থেরাপির কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা

থেরাবটের সম্ভাবনা প্রচুর হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

  • মানবিক স্পর্শের অভাব: এআই মানুষের মতো সহানুভূতি প্রকাশে সীমাবদ্ধ, যা কিছু ব্যবহারকারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

  • জটিল কেস মোকাবিলা: গুরুতর মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে এআই-ভিত্তিক সেবা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে এবং মানুষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

  • নৈতিক উদ্বেগ: ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনীয়তা এবং এআই-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করেছে যে অনিয়ন্ত্রিত এআই বটগুলো ক্ষতির কারণ হতে পারে, যেমন কিছু ক্ষেত্রে আত্ম-ক্ষতির প্ররোচনা।

  • বাজার প্রস্তুতি: গবেষকরা জানিয়েছেন যে থেরাবট এখনও বাজারে ব্যাপক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত নয় এবং আরও গবেষণা ও ট্রায়াল প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব

মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের ঘাটতি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশেরও কম মানুষ এমন সম্প্রদায়ে বাস করে যেখানে পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্য প্রদানকারী রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ঘাটতি আরও তীব্র। থেরাবটের মতো প্রযুক্তি এই ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে যেখানে ঐতিহ্যবাহী সেবা সীমিত।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

থেরাবটের মতো এআই-ভিত্তিক সেবা মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। ভবিষ্যতে এটি নিম্নলিখিত উপায়ে উন্নত হতে পারে:

  • বহুভাষিক সেবা: বিভিন্ন ভাষায় সেবা প্রদানের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি।

  • উন্নত এলগরিদম: আরও জটিল মানসিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য উন্নত প্রযুক্তি।

  • স্থানীয়করণ: স্থানীয় সংস্কৃতি এবং প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেবা প্রদান।

প্রযুক্তি রিভিউ জানায়, এআই থেরাপির ভবিষ্যৎ মানুষের থেরাপিস্টদের প্রতিস্থাপন নয়, বরং তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেবার পরিধি বৃদ্ধি।

উপসংহার

থেরাবট মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর সমাধান প্রদান করে, তবে এর সীমাবদ্ধতা এবং নৈতিক বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। মানবিক এবং এআই-ভিত্তিক সেবার সমন্বয় মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করতে পারে। বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির প্রসার মানুষের মানসিক সুস্থতার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।

Scroll to Top