প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কাজ করছে যে প্রাণীগুলো

307

পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ব মোড়লদের কার্যক্রমের কমতি নেই। প্রতি বছরই কনফারেন্স, জনসচেতনতা, বিশ্ব নেতাদের বৈঠকের সঙ্গে হচ্ছে নানা ধরনের চুক্তি। পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টায় আছে রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, আমাদের চারপাশে থাকা বিভিন্ন প্রাণী কীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রকৃতির পরিচর্যা করে থাকে। আর প্রাণীগুলো নিধনের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি ও নিজেদের কতটা ক্ষতি করছি। এই প্রাণীগুলো রক্ষায় এগিয়ে না এলে ভবিষ্যতে আমরাই বিপন্ন হয়ে যেতে পারি..তাহলে আসুন জানি ও সচেতন হই প্রাণীগুলো সম্পর্কে।

০১. চড়ুই পাখি
পাখিটি আকারে ছোট হলেও আমাদের কতটা প্রয়োজন, তা জেনে সত্যিই অবাক হয়ে যাবেন। তবে একে অপকারী ভেবে প্রতিনিয়ত হত্যা করি, তাড়িয়ে দিই। চড়ুই আমাদের কতখানি উপকার করে তা উপলব্ধি করতে চলুন একটি হৃদয় বিদারক সত্যি ঘটনা জানি। ঘটনাটি চীনের। চড়ুই পাখি ফসল খেয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে ভেবে ১৯৫৮ সালে মাও-সে-তুং -এর নির্দেশে অসংখ্য চড়ুই নিধন করা হয়। কেননা একটি চড়ুই বছরে ৪ থেকে ৫ কেজি শস্য খায়।
সুতরাং, দশ লক্ষ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ৬০ হাজার ব্যক্তির খাদ্যের যোগান দেয়া যেতে পারে। অতএব শুরু হল প্রচারণা। রাতারাতি তৈরি হলো ১ লাখ রঙিন পতাকা। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে উঠল গোটা চীন দেশ। ‘স্প্যারো আর্মি’ কাজে লেগে গেল। পুরস্কার ঘোষণা করা হলো চড়ুই মারার জন্য।
বিভিন্ন পদ্ধতিতে চড়ুই নিধন হতে লাগল। যেমন- খুব জোরে জোরে ড্রাম বাজাতেই চড়ুই উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। ডিম নষ্ট করা হল। তছনছ করা হল বাসা। জাল দিয়ে ধরা হল অসংখ্য চড়ুই। বন্দুক দিয়ে মারা হল বাকি চড়ুই পাখি।
এভাবে ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ নামে প্রচারণার মাধ্যমে চড়ুইশূন্য হল চীন। ১৯৬১-৬২ সাল। চীনে দেখা দিল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মারা গেল প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ। ফসলের ক্ষেতে বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ এমনভাবে বেড়ে গেল যে- ক্ষেত থেকে ফসল আর ঘরেই তোলা গেল না। শুরু হলো দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর মিছিল। টনক-নড়ল দেশটির সরকারের। নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিতে চড়ুই ফিরিয়ে আনতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হল চড়ুই আমদানি।
চড়ুই প্রধানত শস্যদানা, ঘাসের বিচির পাশাপাশি অসংখ্য পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বিশেষ করে পোকার শুককীট, মুককীট বা লেদাপোকা যারা শস্য উৎপাদনের অন্তরায়।
এরা যেসব প্রজাতির পোকামাকড় খায় তাদের মধ্যে বিটল পোকা, ছাড়পোকা, পিঁপড়া, মাছি উল্লেখযোগ্য। চড়ুই এসব পোকার ক্ষতিকর আক্রমণ থেকে ফসল, সবজির ক্ষেত, বনাঞ্চল বাঁচিয়ে পরিবেশ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
আমরা শপথ করি চড়ুই পাখির আমরা আর কখনও ক্ষতি করবো না, এটি রক্ষায় সচেতন হবো।

০২. শকুন
প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে শকুন একটি পরিচিত পাখি। এরা মরা-পচা প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। মরা-পচা প্রাণীর দেহ থেকে দুর্গন্ধ ও জীবাণু ছড়ায়। সেক্ষেত্রে এগুলো খেয়ে রোগ-জীবাণু ও দুর্গন্ধ থেকে আমাদের রক্ষা করে শকুন। নিরাপদ শ্বাস নিতে সাহায্য করে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর অবদান অনস্বীকার্য।
এরা দলবেঁধে বাস করে এবং শিকারী পাখি না হওয়ায় সুস্থপ্রাণীর ওপর আক্রমণ করে না। শুধু মৃত প্রাণীই খেয়ে থাকে। বর্তমানে এই উপকারী পাখিটি মানুষের অসচেতনতা, অজ্ঞতা, অবহেলা আর অদূরদর্শিতার কারণে অতিবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দিন দিন অস্বাভাবিকহারে শকুনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে এরা যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের অনেক আগেই শকুন রক্ষায় সচেতন হওয়া উচিৎ ছিল।

০৩. ব্যাঙ
সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত ৪,৭৪০ প্রজাতির ব্যাঙের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে ১৯৮০ সালের পর প্রায় দুইশ’ প্রজাতির ব্যাঙ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতি মাত্র ৬৩টি।
জল অথবা স্থল- উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাঙের অবাধ বিচরণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাঙ পোকা-মাকড় খেয়ে ফসলের সুরক্ষা করে। ফলে জমিতে অতিরিক্ত কিটনাশক দিতে হয় না। তাই জমির উর্বরতা নষ্ট হয়না।
বিভিন্ন জটিল রোগ ছড়ায় এমন পোকা-মাকড় এরা খায়। বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার বিস্তার ঘটায় এমন মশাও খেয়ে ফেলে। ব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম।
বহুযুগ ধরেই মানুষ ব্যাঙকে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক খাবার হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। প্রতি বছর সোনা ব্যাঙ রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার অর্জন করতো। কিন্তু এ সময়ে ফসলে বিভিন্ন পোকার আক্রমণে আমরা হারিয়েছি কোটি কোটি ডলার। তাই ব্যাঙের ব্যাপারে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া উচিৎ।

০৪. গুই সাপ
গুই সাপকে শত্রু বলে গণ্য করে এদের প্রাণে মেরে ফেলার প্রবণতা বেশি গ্রামীণ জনপদে। কিন্তু গুই সাপ পরিবেশ রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুই সাপের বিচরণ থাকলেও বাংলাদেশে এটি অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা পৃথিবীতে ৭৩ প্রজাতির গুই সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে তিনটি প্রজাতির।
ব্যাপকহারে বন উজাড় আর অহেতুক নানা কুসংস্কারের কারণে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অযথা ভয় পেয়ে মেরে ফেলে গুই সাপকে।
প্রাণী গবেষকদের মতে, পরিবেশের একটি মাংসাশী প্রাণী হিসেবে বস্তুসংস্থানে অথবা প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলে অনন্য ভূমিকা রাখছে গুই সাপ।
এছাড়া বিভিন্ন পঁচা ময়লা- আবর্জনা, মৃত প্রাণী ভক্ষণ করে এটি পরিবেশ দূষণের হাত থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করে।

০৫. মৌমাছি
আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদেরকে সামাজিক পতঙ্গ বলা হয়। মৌমাছি থেকে আমরা মধু ও মোম পাই।
কোনো কোনো প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে চাষ করে মধু উৎপাদন করা হয়। দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্টিহীনতা রোধে মৌমাছি সাহায্য করে।
মোম, মোমবাতি, প্রসাধনী যেমন- কোল্ড ক্রিম, সেভিং ক্রিম, স্নো ইত্যাদিসহ বিভিন্ন প্রকার ঔষধ তৈরিতে মধু ব্যবহার করা হয়। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা, বুক, এবং লোমে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ণ ঘটে।
ফুলের পরাগায়ণের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে এবং জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

০৬. প্রজাপতি
সকালে সূর্যি মামা পূবাকাশে উঁকি দেয়ার আগেই ঘুম ভাঙে প্রজাপতির। দল বেঁধে আহারের খোঁজে ছুটে চলে। ঝোঁপে-ঝাড়ে, বনে-জঙ্গলে, এ গাছ থেকে ও গাছে। সবুজ বনানী, ফুলে ও গাসের ডগায় দিনভর চলে এদের ওড়াউড়ি।
প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের প্রজাপতি দেখা যায়। প্রজাপতি মধু খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা ফুলে ফুলে উড়ে শুধু মধুই খায় না পরাগরেণু স্থানান্তরিত করে ফুলের পরাগায়ন ঘটায়, যার জন্যই ফুল থেকে ফল হয়।
এ ধরনের প্রাণী বেঁচে না থাকলে গাছে ফুলই হবে, কখনও আর ফল জন্মাবে না। ফল না জন্মালে পৃথিবীব্যাপী ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেবে। হুমকির মুখে পড়তে হবে আমাদের।

০৭. কেঁচো
কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙল বলা হয়। কেঁচো মাটি খুঁড়ে মলত্যাগের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ বের করে ‘কেঁচো কম্পোস্ট’ তৈরি করে। এই সার সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব; যা ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন এবং মাটির উর্বরতা বাড়ানো যায়।
রাসায়নিক পদার্থ ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। যার কারণে পরিবেশসহ মানুষ ও জলজপ্রাণীর স্বাস্থ্য ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করলে একদিকে পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কেচো চাষ শুরু হয়েছে। যা পরিবেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। যেহেতু কেচো কম্পোষ্ট আমাদের স্বাস্থ্য উপযোগী এটি ব্যবহারে ভেজাল শষ্য থেকে থেকে বাঁচতে পারি। কিন্তু আমরা নানা রকম কিটনাশক ব্যবহার করে কেচোর বংশ বিস্তার ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছি।