পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করে হেফাজতে ইসলামের আহ্বায়ক কমিটি, নেপথ্যে কী?

389
হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটি, নেপথ্যে কী?

আহমেদ মাহদী, জিনিউজ বিডি ডটকম : বাংলাদেশে মোদিবিরোধী আন্দোলনের জের ধরে হেফাজতে ইসলাম, কওমি মাদরাসা ও আলেম-ওলামাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চরম সংকটে পড়েছে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামী। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ এপ্রিল রাতে সংগঠনটির আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে মাত্র ৫ মাসের মাথায় সে কমিটি ভেঙে দেয়া হলো।

প্রথমে এক ভিডিও বার্তায় বাবুনগরী বলেন, দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ব বৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের পরামর্শে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ইনশা আল্লাহ, আগামীতে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হবে।

কয়েক ঘণ্টা পর হেফাজতে ইসলামের ফেসবুক পেজে এক বিজ্ঞপ্তিতে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রথমে তিন সদস্যের কমিটির নাম ঘোষণা করলেও পরে আরো দুইজনকে কমিটিতে স্থান দেয়া হয়। রাত পৌনে ৪টার দিকে সদ্যঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী তার ফেসবুক পেজে এসে এক ভিডিও বার্তায় পূর্বোল্লিখিত আহ্বায়ক কমিটিতে নতুন দুই সদস্যসহ ৫ জনের নাম ঘোষণা করেন।

তিনি জানান, আহ্বায়ক কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এছাড়া আহ্বায়ক হিসেবে জুনায়েদ বাবুনগরী, সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, সদস্য সালাউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীকে রাখা হয়েছে।

প্রিয় দর্শক, কিন্তু হঠাৎ কেন কমিটি বাতিল করা হলো?

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করলে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে হামলা চালায় ছাত্রলীগের কিছু সন্ত্রাসী। এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলাম প্রতিবাদ মিছিল বের করলে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে কে বা কারা থানায় হামলা করে। এরপর পুলিশের গুলিতে ৪ জন মারা যান। পরের দিন হরতাল ডাকে হেফাজতে ইসলাম। এর পরে প্রাণ হারান অন্তত আরও ১৪ জন।
সেসব ঘটনায় একাধিক মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত নেতাসহ আলেম ওলামাদের আসামি করা হয়। মামলার আসামিদের ধরতে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ পর্যন্ত হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক দ্বিতীয় স্ত্রীসহ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টে হেনস্তা হন। এর জের ধরে অনেক কল্পকাহিনী ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়ায়। এতে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ে হেফাজত।

সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কোণঠাসা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই সমঝোতার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কেউ কেউ অবশ্য হেফাজতকে বাগে আনতে সরকারের পক্ষ থেকেই সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন।

ঘটনা যা-ই হোক, সম্প্রতি হেফাজত ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসায় দেখা করে দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার না করার অনুরোধ জানান। কিন্তু সরকার দৃশ্যত এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়।
এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেয়া হলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন- হেফাজতের ওপর ক্রাকডাউনের কারণে দেশের কওমী মাদরাসাগুলো বেকায়দায় পড়ে গেছে। মাদরাসাগুলো মূলত দান-অনুদানের মাধ্যমে টিকে রয়েছে। কিন্তু আলেমদের গ্রেফতার ও লক ডাউনে মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়ায় রমজানে দানের টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ রমজান মাসেই বছরে অধিকাংশ সময় চলার মতো দান-সাদকাহ সংগ্রহ করা হয় প্রতি বছর।

এমনকি প্রায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারি মাদরাসাও ভিডিও বার্তায় বিষয়টি স্বীকার করে নাগরিকদের কাছে সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ জানায়। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হেফাজতে ইসলামের কমিটি ভেঙে দিয়ে সরকারের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে সংগঠনটি। কারণ সরকার চাচ্ছিল এই কমিটি না থাকুক।

বিশ্লেষকদের আরেকটি অংশ মনে করছেন- হেফাজতের অধিকাংশ নেতাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন নন। ফলে চলমান গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ফলে তারা ব্যক্তিগতভাবে সংগঠনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে সরকারের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন। এ পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারে জনমনে বিভ্রান্তি ও নাখোশ তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই হেফাজতের কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে।

অবশ্য হেফাজতে ইসলামীর শুভাকাঙ্খীদের একটা অংশ মনে করেন- রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরেকটি অংশ মনে করেন- সরকারি চাপে এ কমিটি ভেঙে দেয়া হতে পারে। বিষয়টি পরিষ্কার হতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটিতে আগের কমিটির আমির ও মহাসচিবই বহাল আছেন। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, আগের কমিটির রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিতে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে, এটি আপসকামিতারই অংশ।

তবে ঘটনা যা-ই হোক না কেন, এটা বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের আরেকটি পরাজয় এবং সরকারের একটি সফলতা।

তো প্রিয় দর্শক, এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? জানান মন্তব্যে। আর লেখাটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকুন।