সৌদি রাজকুমারীর কাণ্ড

66

বিল পরিশোধ না করে রাতের বেলায় হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কায়দাটি পুরনো। কিন্তু সঙ্গে যদি ৬০ জন সফরসঙ্গী ও একগাদা ব্যাগ থাকে, সবাইকে নিতে যদি হোটেল গেটে লিমোজিনের বহর রাখতে হয়, তাহলে ব্যাপারটি অত সহজ থাকে না। ২০১২ সালের ৩১ মে রাত সাড়ে ৩টায় প্যারিসের শাংরি-লা হোটেলে এমনটাই ঘটতে যাচ্ছিল। ৭০ লাখ ডলারের বিল বকেয়া রেখে সটকে পড়তে চেয়েছিলেন রাজকুমারী মাহা বিনতে মোহাম্মাদ বিন আহমাদ আল সুদায়রি, যিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে পাঁচ মাস ধরে হোটেলের ৪১টি কক্ষে অবস্থান করেছেন। গভীর রাতে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে পড়লে ছুটে আসেন অনেক পদস্থ কূটনীতিক। শেষ পর্যন্ত রাজকুমারী গিয়ে ওঠেন নিকটস্থ রয়্যাল মঞ্চু হোটেলে, যেটির মালিক কাতার, সৌদি আরবের মিত্র ও প্রতিবেশী।

প্যারিসের অভিজাত ডিস্ট্রিক্ট সিক্সটিনে অবস্থিত হোটেল থেকে সে রাতে রাজকুমারী পালাতে না পারলেও বছরতিনেক আগে পেরেছিলেন। আভেন্যু মন্তেইনের বিলাসবহুল বুটিক শপগুলোয় সেবার তিনি ২ কোটি ডলার মূল্যের পোশাক ও জুতা কিনেছিলেন। কিন্তু মূল্য পরিশোধের সময় হলে তিনি স্রেফ দোকানিদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সেবার রাজকুমারী উঠেছিলেন জর্জ ফাইভ হোটেলে। একাধিক ব্যবসায়ী দিনের পর দিন ওই বিলাসবহুল হোটেলে ধরনা দিয়েছেন পাওনা আদায়ের আশায়। অন্তর্বাস বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও কাপ্রিচ দো লিলির মালিক বলেন, ‘আট বছর ধরে তিনি আমাদের দারুণ একজন ক্রেতা। এর পর হঠাত্ করে অর্থ পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন।’ লেইজারওয়্যার বিক্রেতা কি লার্গোর অনাদায়ী পাওনা সোয়া ১ লাখ ডলার। এমন প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানে বকেয়া রেখে সটকে পড়েছেন রাজকুমারী। এত পাওনাদারকে ফাঁকি দিয়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নে কেটে পড়েছিলেন তিনি। কারণ জর্জ ফাইভ হোটেলটি তারই তুতো প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালালের মালিকানাধীন। কয়েকটি সূত্র জানায়, সেবার সৌদি দূতাবাস রাজকুমারীর এসব পাওনা পরিশোধ করেছিল। তবে তার দেবর ও তত্কালীন বাদশা আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ এ ঘটনা শুনে ভীষণ ক্ষেপেছিলেন। দেশে ফেরার পর তিনি মাহাকে প্রাসাদে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রাজকুমারী মাহা বাদশা আবদুল্লাহর ভাই প্রিন্স নায়েফ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ পত্নী। এ দম্পতি তিন দশক একসঙ্গে ছিলেন। তাদের পাঁচ সন্তানের বয়স ২২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। বাদশা আবদুল্লাহ ও যুবরাজ সুলতান দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০০৯ সাল নাগাদ প্রিন্স নায়েফ হয়ে ওঠেন সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ২০১১ সালের অক্টোবরে সুলতানের মৃত্যু হলে নায়েফকে যুবরাজ ঘোষণা করা হয়। ২০১২ সালের প্রথম দিকে তিনি ও মাহা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন। ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকা প্রিন্স নায়েফ সে বছরের জুনে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান। এর আগে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে রাজকুমারী মাহা রাজকীয় ফরমান অমান্য করে আবারো প্যারিসে পালিয়ে যান বলে দ্য টেলিগ্রাফ জানায়। এর পর শাংরি-লা হোটেল থেকে পালাতে গিয়ে তিনি যে কাণ্ড ঘটান, তাতে বাদশা আবদুল্লাহ তার দিক থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেন।

গত মার্চে নান্তের আদালত রাজকুমারীর কাছ থেকে হোটেল গেটে জব্দ করা মালপত্র নিলামে বিক্রি করে ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। খবরে প্রকাশ, এসব মালপত্রের মধ্যে রয়েছে জামাকাপড়, হ্যাট, হ্যান্ডব্যাগ, অলঙ্কার, শিল্পকর্ম, স্নানের পোশাক, দামি চশমা, সিগারেটের কার্টন, সোনায় মোড়ানো প্লেট, রাজকুমারীর কয়েকটি ফ্রেমে বাঁধা ছবি ও প্রায় ১ হাজার জোড়া জুতা।

দৈনিক দুটি রোলস রয়েস ফ্যান্টমসহ রাজকুমারীকে গোটা তিরিশেক বিলাসবহুল গাড়ি ও চালক সরবরাহ করত যে প্রতিষ্ঠান, তাদের পাওনা প্রায় ৪ লাখ ডলার। লো প্যারিজিয়ানের প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটি মন্তব্য করেছে, ‘ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও আমরা তার সঙ্গে লেনদেনের লোভ সংবরণ করতে পারিনি।’ শাংরি-লা হোটেলের মুখপাত্র বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পাওনা অর্থ পেয়েছি। এ ব্যাপারে কিছু বলতে আগ্রহী নই।’ কি লার্গোর মালিকও পাওনা আদায়ের কথা জানিয়েছেন।

আসলে সমস্যা হলেও কেউ রাজকুমারীর কাছে পণ্য বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। দীর্ঘদিন ধরে ধনাঢ্য সৌদিদের প্রিয় গন্তব্য প্যারিস। সাধারণত অভিজাত ডিস্ট্রিক্ট আটের আশপাশে অবস্থান করে সৌদিরা। কারণ বাহারি ও বিলাসবহুল পণ্যের জমকালো দোকানগুলো এ এলাকাতেই। তাদের পছন্দের হোটেলগুলোও এখানেই। জর্জ ফাইভ (সৌদি যুবরাজের) ও প্লাজা এথেনার (ব্রুনেইর সুলতানের) বাইরে সস্তা হোটেলে তারা পা ফেলেন না। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র ভ্যানিটি ফেয়ারকে বলেন, ‘তারা রিতযে ওঠার মানুষ নয়। কেনাকাটার ক্ষেত্রেও জমকালো জিনিসই তাদের পছন্দ। ভিশন ও শানেলের মতো ভারী জিনিস তাদের প্রিয়, আরমেস নয়।’

রাজকুমারী মাহা আবারো নিজের প্রাসাদে আটক রয়েছেন। এবার তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সৌদি রাজপরিবারে সহোদর ও বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা আবদুল আজিজ তার ২২ স্ত্রীর গর্ভে ৪৫ পুত্রের পিতা হয়েছেন। সবচেয়ে প্রিয়তমা পত্নী হাসা বিনতে আহমাদ আল সুদায়রি হলেন নেজদ প্রদেশের বিখ্যাত সুদায়রি পরিবারের মেয়ে। কারো কারো মতে, আবদুল আজিজ বাদশা হওয়ার আগেই যখন হাসাকে বিয়ে করেন, তখন তার বয়স ছিল ১৩ বছর। কয়েক বছর পর বাদশা তাকে তালাক দেন। কিন্তু কিছুদিন পর আবারো তিনি হাসাকে বিয়ে করেন। ১৯৫৩ সালে বাদশা আবদুল আজিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের ১২ সন্তানের জন্ম হয়েছিল। এ দম্পতির সাত পুত্র ‘সুদায়রি সেভেন’ বলে পরিচিত, যারা রাজপরিবারে সহোদরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রুপ। অন্য কোনো স্ত্রীর গর্ভে বাদশার এত ছেলের জন্ম হয়নি। বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হওয়ায় সুদায়রিদের প্রতিপত্তি বাড়বে বৈ কমবে না। প্রিন্স নায়েফের পুত্র প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন নায়েফকে সম্প্রতি ডেপুটি যুবরাজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রিন্স মোহাম্মদ রাজকুমারী মাহার সন্তান নন, তিনি রাজকুমারী আল জাওহারার গর্ভজাত। তবে মাহার সন্তানদের রমরমা কম নয়। তার কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স ফাহাদ গত বছর স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্যারিসের ডিজনিল্যান্ডে ৬০ জন বন্ধুর জন্য যে পার্টি দেন, তাতে খরচ হয় ২ কোটি ডলার।

সম্রাট ন্যাপলিয়ঁ বোনাপার্তের নাতি প্রিন্স রোলাঁ বোনাপার্তের প্রাসাদ হিসেবে নির্মিত শাংরি-লা প্যারিসের অন্যতম দামি হোটেল, যেখানে স্যুটের ভাড়া প্রতিদিন ন্যূনতম ২৩ হাজার ডলার। রাজকুমারী মাহা অবশ্য হোটেলের বিলাসবহুল সেবার সামান্যই নিয়েছেন। তিনি নিজের ড্রাইভার, রাঁধুনি, পরিচারিকাদের সৌদি আরব থেকেই নিয়ে  গেছেন। হোটেলে থাকাবস্থায় রাজকুমারীকে মাত্র দু-তিনবার দিনের আলোয় বেরুতে দেখা গেছে। হোটেল কর্মীরাও তার দেখা পেয়েছেন কদাচিত্। জনাদশেক দেহরক্ষীর ভিড়ে তিনি কেবল দরজা থেকে বাইরে পা ফেলে গাড়িতে চড়তেন। চ্যাম্পস এলিজির লই ভিশন আউটলেটের পাশাপাশি ডিওর, দলচে অ্যান্ড গাবানা, শমেত ও ভিক্টোরিয়া কাসালের দোকান তার সুবিধার্থেই মধ্যরাতে খোলা হতো। প্যারিস থেকে সেবার জেনেভায় বেড়াতে গিয়ে তিনি যে কেনাকাটা করেন, সেসব জিনিস নিয়ে যেতে চারটি ট্রাক লেগেছিল!
সুত্রঃ বনিক বার্তা