বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে “শরিয়াহ আইন” শব্দটি শুনলেই অনেকের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, শরিয়াহ মানেই হাত কাটা, পাথর মারা বা কঠোর শাস্তি। কিন্তু আসলে এটি শরিয়াহর একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র, তাও খুব নির্দিষ্ট ও কঠিন শর্তসাপেক্ষে প্রযোজ্য।
শরিয়াহর প্রকৃত চেহারা অনেক বিস্তৃত, অনেক বেশি ন্যায়বিচারপূর্ণ ও কল্যাণকামী।
চলুন সহজভাবে বুঝে নেই—
কেন “শরিয়াহ মানেই শাস্তি নয়” এই কথাটি সত্য, এবং এর আসল উদ্দেশ্য আসলে কী।
শরিয়াহ মানে কী?
“শরিয়াহ” শব্দটি এসেছে আরবি “শর’আ” থেকে, যার অর্থ পথ— এমন এক পথ যা মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে পৌঁছে দেয়।
এটি শুধু আইনি বিধান নয়; বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ পথনির্দেশ।
👉 নামাজ, রোজা, ব্যবসায় ন্যায়নীতি, পারিবারিক সম্পর্ক, প্রতিবেশীর অধিকার, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজ—সব কিছুই শরিয়াহর অন্তর্ভুক্ত।
অর্থাৎ, শরিয়াহ হলো:
“ন্যায়, দয়া, কল্যাণ ও জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনবিধান।”
(ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, আল-ইলাম)
শরিয়াহর উদ্দেশ্য: শাস্তি নয়, সুরক্ষা
শরিয়াহর মূল লক্ষ্য হলো মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার রক্ষা করা (মাকাসিদ আল-শরিয়াহ):
1️⃣ ধর্ম – বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের সুযোগ
2️⃣ জীবন – মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষা
3️⃣ বুদ্ধি – জ্ঞান ও চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষা
4️⃣ বংশ – পরিবার, সমাজ ও নৈতিকতা সংরক্ষণ
5️⃣ সম্পদ – অন্যায়ভাবে সম্পদ নষ্ট বা ছিনিয়ে নেওয়া থেকে সুরক্ষা
➡️ অর্থাৎ, শরিয়াহর সব বিধান এই পাঁচটি লক্ষ্য পূরণের জন্য।
শাস্তি কখনোই লক্ষ্য নয়, বরং ন্যায় ও সুরক্ষা রক্ষার মাধ্যম।
শাস্তির ধারণা কোথা থেকে এলো?
কিছু মিডিয়া ও রাজনীতির কারণে অনেকেই শরিয়াহকে কেবল হাদ্দ (Hudud) শাস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করেন—যেমন চুরি করলে হাত কাটা বা ব্যভিচারে পাথর মারা।
কিন্তু এগুলো শরিয়াহর মাত্র একটি ক্ষুদ্র ও বিরল অংশ।
আর এর প্রয়োগের জন্য শর্ত এত কঠোর যে বাস্তবে তা প্রায় কখনোই কার্যকর হয় না।
প্রসিদ্ধ আলেম ইমাম গাজালী র. বলেন—
“শরিয়াহর শাস্তি হলো শেষ বিকল্প, মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সংশোধন ও সমাজের নিরাপত্তা।”
বাস্তবে শরিয়াহ কেমন?
দয়া ও ক্ষমা: কোরআনে বলা হয়েছে,
“আল্লাহ ন্যায়বিচার, দয়া ও আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করার আদেশ দেন।” (সূরা নাহল ১৬:৯০)
ন্যায় ও ইনসাফ ভারসাম্য: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যেন অন্যায়ের প্রতিশোধে অন্যায় না করে।” (মুসলিম)
সমাজকল্যাণ: শরিয়াহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ন্যায্যতা, দরিদ্রদের জন্য যাকাত, অন্যায় প্রতিরোধ ও মানবিক সহযোগিতা নিশ্চিত করে।
অর্থাৎ, শরিয়াহর মূল রূপ হচ্ছে একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ গঠন।
কেন মানুষ ভয় পায়?
1️⃣ অজ্ঞতা – শরিয়াহর পূর্ণ চিত্র না জানার কারণে
2️⃣ মিডিয়ার বিকৃত প্রচার – কেবল কঠোর শাস্তি দেখানো
3️⃣ রাজনৈতিক অপব্যবহার – কিছু দেশে ক্ষমতা রক্ষার জন্য শরিয়াহর নাম ব্যবহার
4️⃣ ঐতিহাসিক বিকৃতি – ঔপনিবেশিক যুগে শরিয়াহকে পিছিয়ে থাকা আইন হিসেবে চিত্রিত করা
ফলে অনেকেই শরিয়াহ মানেই শাস্তি ভেবে ভয় পান—
কিন্তু সত্য হলো, শরিয়াহর উদ্দেশ্য মানুষকে শাস্তি দিয়ে ভয় দেখানো নয়, বরং রক্ষা করা।
শরিয়াহর বাস্তব উদাহরণ
🕌 নবী (সা.)-এর রাষ্ট্রে শরিয়াহর প্রয়োগের ফলে
- ন্যায়বিচার ছিল সর্বোচ্চ,
- মানুষ ছিল নিরাপদ,
- মুসলিম-অমুসলিম সবাই সমান অধিকার ভোগ করত।
রাসুল (সা.) বলেছেন:
“আল্লাহ দয়া ও সহনশীলতাকে ভালোবাসেন; যেখানে দয়া থাকে, সেখানে কল্যাণ নেমে আসে।” (সহিহ মুসলিম)
উপসংহার: শরিয়াহ আইন কোনো ভয়ঙ্কর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং মানুষকে ন্যায়, দয়া ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করার নির্দেশনা।
এটি আল্লাহর দেওয়া জীবনের পূর্ণাঙ্গ নকশা, যেখানে শাস্তি কেবল তখনই প্রযোজ্য, যখন সমাজের ন্যায় ও নিরাপত্তা রক্ষার অন্য সব উপায় ব্যর্থ হয়।
📌 তাই, শরিয়াহ মানেই শাস্তি নয়।
বরং শরিয়াহ মানে—
✨ ন্যায়
✨ দয়া
✨ কল্যাণ
✨ নিরাপত্তা
✨ মানবতার সুরক্ষা
যে সমাজ শরিয়াহর আসল উদ্দেশ্যকে বুঝে গ্রহণ করে, সেখানে অন্যায়, ভয় আর বৈষম্যের কোনো স্থান থাকে না—
থাকে শুধু শান্তি, ন্যায় ও মানবকল্যাণ।



