মুমিনদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী

মুমিনদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী

 يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَلَآ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ ۚ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَاُولٰۤىِٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ

বাংলা অনুবাদ: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ না করে। আর যারা এমনটি করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

আয়াতের প্রেক্ষাপট

এই আয়াতটি সূরা আল-মুনাফিকুনের একটি অংশ, যেখানে মুমিনদের জন্য আল্লাহর পথে নিষ্ঠা ও ত্যাগের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এই সূরাটি মূলত মদিনায় অবতীর্ণ এবং এটি মুনাফিকদের (কপট বিশ্বাসীদের) আচরণ ও মুমিনদের জন্য সতর্কবাণী নিয়ে আলোচনা করে। এই আয়াতে মুমিনদের সতর্ক করা হচ্ছে যেন তারা দুনিয়ার মোহে পড়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত না হন।

তাফসির ও ব্যাখ্যা

বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ যেমন তাফসির ইবনে কাসির, তাফসির জালালাইন, তাফসির তাবারি এবং মাওলানা মুফতি শফি উসমানির মারিফুল কুরআনের আলোকে এই আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

১. আল্লাহর স্মরণ (ذِكْرِ اللّٰهِ) এর অর্থ

  • তাফসির ইবনে কাসির: এখানে “আল্লাহর স্মরণ” বলতে কেবল মৌখিক জিকির (যেমন তাসবিহ, তাহলিল) বোঝানো হয়নি। এটি একটি বিস্তৃত অর্থ বহন করে, যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নির্দেশ পালন, নিষেধ থেকে বিরত থাকা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সকল কাজ। ইবনে কাসির উল্লেখ করেন, এই আয়াত মুমিনদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের ইবাদত ও আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
  • তাফসির জালালাইন: এই তাফসিরে বলা হয়, “আল্লাহর স্মরণ” বলতে বিশেষ করে নামাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। সম্পদ ও সন্তানের ব্যস্ততার কারণে নামাজে অবহেলা করা এই আয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
  • মারিফুল কুরআন: মুফতি শফি উসমানি ব্যাখ্যা করেন যে, আল্লাহর স্মরণ মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। সম্পদ ও সন্তান দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত, কিন্তু এগুলো যদি আল্লাহর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।

২. সম্পদ ও সন্তানের প্রভাব (اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ)

  • তাফসির তাবারি: এই তাফসিরে বলা হয়, সম্পদ ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা। এগুলো আল্লাহর দান, কিন্তু এদের প্রতি অতিরিক্ত মোহ মানুষকে আখিরাতের প্রস্তুতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাবারি উল্লেখ করেন, এই আয়াত মুমিনদের সতর্ক করে যেন তারা দুনিয়ার প্রতি এতটাই আসক্ত না হন যে, আল্লাহর স্মরণ ভুলে যান।
  • ইমাম রাজি (তাফসির কাবির): ইমাম রাজি ব্যাখ্যা করেন, সম্পদ ও সন্তান মানুষের জন্য সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। এগুলোর প্রতি মোহ মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের জীবনের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে শিক্ষা দিচ্ছেন।

৩. ক্ষতিগ্রস্তদের পরিণতি (هُمُ الْخٰسِرُوْنَ)

  • তাফসির ইবনে কাসির: যারা আল্লাহর স্মরণের পরিবর্তে দুনিয়ার সম্পদ ও সন্তানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়, তারা আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্ষতি শুধু আখিরাতের শাস্তি নয়, বরং দুনিয়াতেও তারা মানসিক শান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য থেকে বঞ্চিত হয়।
  • মাওলানা মাওদুদি (তাফহিমুল কুরআন): মাওদুদি ব্যাখ্যা করেন, এই আয়াতে ক্ষতির ধারণাটি গভীর। যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তারা তাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। দুনিয়ার সম্পদ ও সন্তান ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক চিরস্থায়ী।

৪. আধুনিক স্কলারদের ব্যাখ্যা

  • মুফতি তাকি উসমানি: তিনি বলেন, এই আয়াত আধুনিক যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকাল মানুষ সম্পদ, ব্যবসা, চাকরি ও পারিবারিক দায়িত্বের পিছনে এতটাই ব্যস্ত যে, আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদতের জন্য সময় পায় না। এটি একটি আধ্যাত্মিক ক্ষতি, যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে বঞ্চিত করে।
  • নোমান আলি খান: তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর স্মরণ মানুষের জীবনে ভারসাম্য আনে। সম্পদ ও সন্তানকে ভালোবাসা স্বাভাবিক, কিন্তু এগুলো যদি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের বাধা হয়, তবে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তিনি মুমিনদের উৎসাহ দেন যেন তারা নিয়মিত নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।

আয়াতের শিক্ষা ও প্রয়োগ

১. অগ্রাধিকার নির্ধারণ: মুমিনদের জন্য আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর নির্দেশ পালন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সম্পদ ও সন্তান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এগুলো যেন ইবাদতের পথে বাধা না হয়। ২. নামাজের গুরুত্ব: নামাজ হলো আল্লাহর স্মরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই আয়াত মুমিনদের সতর্ক করে যেন তারা নামাজে অবহেলা না করে। ৩. দুনিয়ার মোহ থেকে সতর্কতা: সম্পদ ও সন্তান দুনিয়ার জীবনের শোভা, কিন্তু এগুলো পরীক্ষা। মুমিনদের উচিত এগুলোকে আল্লাহর পথে ব্যবহার করা, না যেন এগুলো তাদের আল্লাহ থেকে দূরে সরায়। ৪. আখিরাতের প্রস্তুতি: এই আয়াত মুমিনদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতে সফলতা পেতে হলে আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর আনুগত্য অপরিহার্য।

উপসংহার

এই আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী। এটি জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার শিক্ষা দেয়, যেন দুনিয়ার সম্পদ ও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর পথে চলার পথে বাধা না হয়। বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ ও স্কলারদের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর স্মরণ মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য এবং এটি পরিত্যাগ করা ক্ষতির কারণ হয়। মুমিনদের উচিত নিয়মিত নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।

Scroll to Top