মানুষ স্বভাবগতভাবে সামাজিক প্রাণী। একা কেউই জীবনে টিকে থাকতে বা উন্নতি করতে পারে না। তাই ইসলামে সমাজ, জামায়াত, ও সংগঠনের সাথে থাকা শুধু একটি নৈতিক আহ্বান নয়, বরং একটি ধর্মীয় নির্দেশ। ইসলাম ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং সমষ্টিকেন্দ্রিক (collective) ধর্ম। কুরআন ও সুন্নাহ উভয়েই মুসলমানদেরকে সংগঠিতভাবে চলার, নেতৃত্ব মান্য করার এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
১. কুরআনের আলোকে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা
(ক) ঐক্যের আদেশ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু (কিতাব)-কে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, এবং বিভক্ত হয়ো না।”
📚 সূরা আলে ইমরান (৩): ১০২-১০৩
🔹 ব্যাখ্যা: এখানে “اعتصموا بحبل الله جميعا” অর্থাৎ “তোমরা সবাই একসাথে আল্লাহর রজ্জু ধারণ করো” — এটি সমষ্টিগত ঐক্য ও সংগঠনের নির্দেশ। “ولا تفرقوا” বিভক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(খ) বিচ্ছিন্নতার নিষেধ
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا
“তোমরা মুশরিকদের মতো হয়ো না, যারা তাদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং দলে দলে হয়েছে।”
📚 সূরা রূম (৩০): ৩১-৩২
🔹 ব্যাখ্যা: বিভক্তি শিরকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই একত্রে থাকা ঈমানের নিদর্শন।
(গ) নেতৃত্ব মান্য করার নির্দেশ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বধারী (উলুল আমর) তাদেরও।”
📚 সূরা নিসা (৪): ৫৯
🔹 ব্যাখ্যা: উলুল আমর অর্থাৎ নেতৃত্বধারীদের মান্য করা সংগঠনের নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার অপরিহার্য অংশ।
২. সুন্নাহর আলোকে সংগঠনের গুরুত্ব
(ক) জামায়াতের সাথে থাকা নিরাপদ
عليكم بالجماعة وإياكم والفرقة، فإن الشيطان مع الواحد وهو من الاثنين أبعد، ومن أراد بحبوحة الجنة فليلزم الجماعة
“তোমরা জামায়াতের সাথে থেকো, বিভক্তি থেকে দূরে থেকো। কারণ শয়তান একাকী ব্যক্তির সাথে থাকে এবং দুই জন থেকে দূরে থাকে। যে জান্নাতের প্রশান্তি চায়, সে যেন জামায়াতকে আঁকড়ে ধরে।”
📚 (সুনান আত-তিরমিজি, হাদীস: ২১৬৫)
(খ) বিচ্ছিন্নতা ধ্বংসের পথ
من فارق الجماعة شبرا فمات فميتته جاهلية
“যে ব্যক্তি জামায়াত থেকে একবিন্দু দূরে সরে যায় এবং সেই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।”
📚 (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৭৯৩)
(গ) নেতৃত্ব মান্য করা অপরিহার্য
من أطاع الأمير فقد أطاعني ومن عصى الأمير فقد عصاني
“যে নেতা (আমির)-এর আনুগত্য করে, সে আমারই আনুগত্য করে; আর যে নেতা অমান্য করে, সে আমারই অমান্য করে।”
📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৯৫৭)
৩. আধুনিক প্রেক্ষাপটে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা
আজকের যুগে এককভাবে কাজ করা কার্যকর নয়। ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা, সমাজ সংস্কার, শিক্ষা উন্নয়ন বা মানবিক কল্যাণ—যেকোনো লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করতে হলে সংগঠিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
✳ আধুনিক বাস্তবতার যুক্তি:
- Collective Power: সংগঠন একত্রে মানুষের শক্তি ও সম্পদকে ব্যবহারযোগ্য করে।
- Leadership & Management: সংগঠন নেতৃত্ব গড়ে তোলে এবং সিদ্ধান্তে শৃঙ্খলা আনে।
- Social Impact: সংগঠিত প্রচেষ্টা সামাজিক পরিবর্তন আনে।
- Accountability: সংগঠনের মাধ্যমে কাজের মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
- Networking: সংগঠন মানুষকে যুক্ত করে বৃহত্তর প্রভাব সৃষ্টি করে।
৪. ইসলামী ইতিহাসে সংগঠনের ভূমিকা
মদীনায় নবী ﷺ মসজিদ ও মজলিস গঠন করে একটি সুসংগঠিত সমাজ গড়ে তোলেন।
সাহাবারা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন—সংগঠন ও নেতৃত্বের মাধ্যমে।
তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন যুগেও ইসলাম ছড়াতে সংগঠন ও ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৫. উপসংহার
- কুরআন ও সুন্নাহ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে—বিভক্তি ধ্বংসের পথ, আর জামায়াত ও সংগঠন সফলতার পথ।
- আধুনিক যুগে ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগ যতই ভালো হোক, সংগঠিত নেতৃত্ব ও দলগত প্রচেষ্টা ছাড়া স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়।
- তাই একজন মুমিনের জন্য সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা, নেতৃত্ব মান্য করা এবং বিভক্তি পরিহার করা ঈমানের দাবি।
সারসংক্ষেপ
দিক নির্দেশনা
কুরআন ঐক্য বজায় রাখা, বিভক্তি বর্জন, উলুল আমরের আনুগত্য
সুন্নাহ জামায়াতের সাথে থাকা, নেতৃত্ব মান্য করা, বিভক্তি থেকে দূরে থাকা
আধুনিক দৃষ্টিকোণ দলগত প্রচেষ্টা সফলতা আনে, সংগঠন নেতৃত্ব ও প্রভাব বাড়ায়



