আন্দামান সাগরে মোহাম্মদ কয়েসের জীবন-মৃত্যুর লড়াই

17

ইন্দোনেশিয়ার উপকুলে ডুবে যাওয়া একটি নৌকা থেকে যে প্রায় আটশো অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করে উপকুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন বহু বাংলাদেশি। মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এদের নৌকায় তোলা হয়েছিল। এরপর দু মাস ধরে তাদের সাগরে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। উদ্ধারপ্রাপ্তদের একজন একজন বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ কয়েস। এখন আছেন ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের এক ক্যাম্পে। বিবিসি বাংলার মিজানুর রহমান খানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা:
আমার নাম মোহাম্মদ কয়েস। গ্রামের বাড়ী সুনামগঞ্জ জেলায়। আমি মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য গত মার্চ মাসে বাড়ী থেকে বের হই। আমার মনে আছে তারিখটা। ১৯শে মার্চ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখে আমি রওনা হয়েছিলাম।
গত দুমাসের বেশি সময় ধরে আমি সাগরে ছিলাম। এই কয়েক মাস কিভাবে ছিলাম, বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের নৌকায় খাবার ছিল না, পানি ছিল না। আমাদের ওপর প্রতিদিন নির্যাতন চলতো। আমাদের গালি-গালাজ করা হতো। পানিতে ফেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি রক্ষা পেয়েছি।

উদ্ধারপ্রাপ্তদের রাখা হয়েছে আচেহ প্রদেশের এক শিবিরে
আমরা বঙ্গোপসাগর থেকে যখন রওনা হই, তখন প্রথমে ছোট ছোট নৌকায় তোলা হয়। অনেকগুলো নৌকা ছিল। এই সব ছোট ছোট নৌকার মানুষ সব একদিন একটা বড় নৌকায় তোলা হলো। প্রায় এক হাজার লোক। বার্মার লোক, বাংলাদেশের লোক, দুই দেশের লোকই আছে। পাচারকারীরা বললো তোমাদের এবার মালয়েশিয়া নিয়ে যাব। তোমরা মালয়েশিয়ায় ঢুকে যাবা।
প্রায় ৭২ ঘন্টা ধরে আমাদের নৌকা চলেছিল। কিন্তু যেদিন আমরা রওনা হই, সেদিন নৌকায় ভয়ংকর মারামারি শুরু হলো। পাচারকারীরা একটা লোককে গুলি করে মেরে ফেললো। নৌকায় সবাই ভয় পেয়ে গেল।
তিন দিন ধরে চলার পর নৌকাটা সাগরের যেখানে এসে থামলো, সেখানে একটা স্পীডবোট আসলো। আমাদের নৌকার ক্যাপ্টেন আর তাদের সব লোকজন সেই স্পীডবোটে পালিয়ে গেল। সাগরের মাঝখানে আমাদের এই অবস্থায় ফেলে রেখে।
এরপর আমাদের তো খুব অসহায় অবস্থা। নৌকায় তেল নাই। ইঞ্জিন নষ্ট। পানি নাই। খাবার নাই। তারপর বার্মার লোকরা জাহাজের দায়িত্ব নিল। এরপর তারা টর্চার শুরু করলো আমাদের বাংলাদেশিদের ওপর। যখন খুশি আমাদের মারধোর করে।

বাংলাদেশিদের অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে
আমাদের নৌকা কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে, কিছুই আমরা বুঝতে পারি না। কিছুদিন পর ইন্দোনেশিয়ার নেভির লোক এসে আমাদের নৌকা ধরে। ওরা আমাদের নুডলস এবং পানি দেয়। কিন্তু বার্মার লোকজন আমাদের নুডলসও খেতে দেয়নি, পানিও খেতে দেয়নি। আমাদের বাংলাদেশি লোক সবাই অসুস্থ।
ইন্দোনেশিয়ান নেভি আমাদের নৌকাটা মালয়েশিয়ার সীমানায় এনে ফেলে দিয়ে চলে যায়। এরপর আমরা পড়ি বিপদে। এরপর আসলো মালয়েশিয়ান নেভি। ওরাও একইরকম খাবার দিল। নুডলস আর পানি দিল। আমাদের নৌকা টেনে নিয়ে তারাও দূর সমূদ্রে ফেলে দিয়ে চলে গেল।
এরপর আমরা কষ্টে আছি। বিশদিন ধরে সাগরে ভাসছি। সাগরের পানি খেয়ে আছি। সবার ডায়ারিয়া। কেউ দাঁড়াতে পারে না। এই বিশ দিন একবার ইন্দোনেশিয়ান নেভি আসছে, একবার মালয়েশিয়ান নেভি আসছে। সবাই খাবার দিয়ে চলে গেছে। কেউ সাহায্য করেনি।
সাগরের পানি, ঝিনুক খেয়ে বেঁচে ছিলাম। কেউ প্রস্রাব খেয়ে বেঁচে ছিল।
জাহাজে একদিন মারামারি লাগলো বার্মা আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষকে পানিতে ফেলে ওরা মারলো।
একদিন নৌকা ফুটো হয়ে গেল। পানি উঠতে লাগলো। তখন ইন্দোনেশিয়ার যে ফিশিং বোটগুলো আছে, ওরা এসে আমাদের উদ্ধার করলো। সারারাত ধরে চালিয়ে আজ সকালে (শুক্রবার) ওরা আমাদের ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে আসে। এর মধ্যে দেড়শো লোক মারা গেছে পানিতে পড়ে।
যারা বুড়ো ছিল, যারা ডায়ারিয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ওরা বাঁচেনি।
এখন ভালো আছি। খাবার দাবার পাচ্ছি। চিকিৎসা পাচ্ছি।
আমাদের নিয়ে এখন কি করবে জানি না। আমরা অনুরোধ করেছি, আমাদের দেশের লোকজনকে খবর দাও।
সূত্রঃবিবিসি