পরীক্ষা দিয়েই বাবার জানাজায় রিদাদ

53

বাবার মরদেহ হিমঘরে রেখে স্কুল পরীক্ষায় বসেছে কিশোর রিদাদ, ফিরেই অংশগ্রহণ জানাজায়। সকালে মা তাকে এগিয়ে দিয়েছে স্কুল ড্রেস, দিয়েছে সাহস। জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ড্রেস পরেই এসেছিল সে বাবার জানাজায়। জীবনের কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি কিশোর ছলছল চোখে উপস্থিতদের বলল, ‘আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। আমি জানি- আমার বাবা জান্নাতবাসী হবেন, ইনশা আল্লাহ।’ বাবা ফয়সল আরেফিন দীপনকে শেষ বিদায় জানাতে একমাত্র ছেলের এ উচ্চারণ জানাজায় শরিক সবাইকে আবেগাপ্লুত করে তোলে।

জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে গতকাল ফুলেল শ্রদ্ধায় বিদায় জানায় সর্বস্তরের মানুষ। দুপুর ১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। দুপুর ২টা ৪২ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে। এ সময় পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

পরীক্ষা দিয়েই বাবার জানাজায় রিদাদজেএসসি পরীক্ষা হল থেকে বের হয়েই বাবার জানাজায়। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে ফয়সল আরেফিন দীপনের জানাজায় নাতি রিদাদসহ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছবি : কালের কণ্

গতকাল সকালে দীপনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শোক-ক্ষোভ মিলিয়ে এক অন্য পরিবেশ। সৃষ্টিশীল ও মুক্তমনা সন্তানের এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না কেউই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নির্মিত কবি সুফিয়া কামাল হলসংলগ্ন ভবন ‘প্রফুল্ল’। আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের এ আবাসস্থলের কোথাও নেই এখন প্রফুল্লতা। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দীপনের মরদেহ আনা হয়েছিল এ ভবনের নিচে। স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি শোকস্তব্ধ হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে। দীপনের আধো খোলা মুখে হাত বুলিয়ে বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক করলেন শেষ আদর। এ বোবা কান্নায় তীব্রতা এনে দীপনের স্ত্রী বলেন, ‘আসুন, একটু দোয়া পড়ি। আল্লাহ যেন তাঁর (দীপন) সব গুনাহ আমাকে দিয়ে দেন। ফেরেশতার মতো মানুষ ছিলেন তিনি।’ মোনাজাত শেষে দুই হাতে স্বামীর মুখটি স্পর্শ করে বলে ওঠেন তিনি- ‘খুব কষ্ট লাগছে তোমার, তাই না?’

দীপনের শেষ বিদায়ক্ষণের সব কষ্ট কফিনের পাশে চেয়ারে বসে চুপচাপ অনুভব করলেন মা রোকেয়া প্রধান। নির্বাক-নিথর তাঁর উপলব্ধি প্রকাশ করছিল অনেক কিছু। দীপনের আদরের ছোট্ট মেয়ে রিদমা এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ‘বাবা নেই’- এটা বুঝে নিতে হয়তো সময় লাগবে ওর। বাবার নিথর দেহটির সামনে বসে শুধুই চোখের পানি মুছে নিচ্ছিল সে।

পরিবার-স্বজনদের ‘শেষ দেখা’র পর ফয়সল আরেফিন দীপনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানেই স্কুল ড্রেস পরে উপস্থিত হয় অবিকল দীপনের মতো দেখতে এক কিশোর। নাম তার রিদাদ। গতকাল অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে সে। পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাকে সাহস জুগিয়েছে এ পরীক্ষায় অংশ নিতে। বাবার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের দিকে তাকিয়ে অনেকেই ফেলেছেন চোখের জল। দীপনের জানাজায় অংশ নেন হাজারো মানুষ। বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শ্বশুর ডা. জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি, ঢাবি উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। এ ছাড়া জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার প্রধানরাও। ‘দীপন হত্যার বিচার চাই’ লেখা কালো ব্যাজ ধারণ করে জানাজায় অংশ নেন দীপনের বন্ধুরা। ‘ঢাকা কলেজের ১৯৯১ ব্যাচ’-এর ব্যানারে তাঁরা একটি মানববন্ধন করেন মসজিদের সামনের সড়কে। সেখানে লেখা ছিল ‘বন্ধু হত্যার বিচার চাই’।

এদিকে শনিবার রাত ১১টার দিকে নিহত দীপনের বাসায় যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া ও তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলে সমবেদনা জানান। উপস্থিত সাংবাদিকদের উপাচার্য বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমরা একজন শিক্ষকের সন্তান অভিজিৎকে হারিয়েছি। এবার হারিয়েছি অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক দীপনকে, তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সন্তান। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত।’

শনিবার রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

সূত্রঃ কালেরকন্