জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া

115

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয় খুবই গুরুত্ব পায়। মানুষেরা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা-সাধনা করেন, দীর্ঘ মেয়াদে জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখেন, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানের গভীরতা বাড়ান, জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিবর্তন-উৎকর্ষতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সচেষ্ট থাকেন।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে মানুষ ইতিহাস বিকৃতি করে না, মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ায় না, জ্ঞানবিচ্যুতি ও পশ্চাৎপদতা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তাদের থাকে উন্নত ও সর্বজনীন চিন্তাশক্তি, তাদের জ্ঞান বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা জ্ঞানের অনেক অজানা বিষয় ও জগৎ সম্পর্কে ভাবে এবং তাদের মন ও মানসিকতাও ইতিবাচক-শুদ্ধ-সুন্দর।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকে, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকে, সামাজিক সম্প্রীতি থাকে, পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকে এবং রাজনৈতিক ঐক্যের শক্তি থাকে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নাগরিকরা উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলতে নিবেদিত থাকে, প্রতিটি সেক্টর সুচিন্তিত-সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষের মানসিকতা হয় উন্নত, দৃষ্টিভঙ্গি হয় ইতিবাচক, রুচিবোধ হয় সুন্দর; এরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়, ঐতিহ্য ও শিকড়কে ভুলে যায় না এবং দেশীয়-স্বজাতীয় নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে সামনে এগিয়ে চলতে গবেষণা হয়, বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে পরশ্রীকাতরতা থাকে না, গীবত থাকে না, আরেকজনের উন্নতিতে ঈর্ষা করার সংকীর্ণতা থাকে না, গোঁড়ামি ও মানুষের গোলামির মানসিকতা থাকে না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষ হয় স্বার্থহীন, সংস্কারমনষ্ক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, সাহসী ও মানসিকভাবে দৃঢ়তা সম্পন্ন; যারা মিথ্যা-অন্যায়ের পথে যাতে সমাজ এগিয়ে না যায় সেজন্য স্বতস্ফূর্ত-সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াই এমন যে, এই সমাজের মানুষ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র-স্রষ্টার প্রতি দায়বদ্ধতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সমাজব্যবস্থাকে আরো অগ্রসরমাণ করে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞান আহরণের সুযোগ বেশি, যেখানে জ্ঞান বাণিজ্যিকীকরণের চেয়ে জ্ঞান বিতরণই প্রাধান্য পায়।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষ জ্ঞানে যেমন সমৃদ্ধ তেমনি মানুষের মানসিকতাও খুবই সমৃদ্ধ। এরা প্রয়োজন ও সমস্যার সাময়িকভাবে সমাধানের চেয়ে স্থায়ীভাবে সমাধানে বেশি মনোযোগী। এরা উৎস যাচাই না করে তথ্য বিশ্বাস করেন না, কারণ না জেনে গুজব-মিথ্যা প্রপাগান্ডায় কান দেন না, বিশ্লেষণ না করে গ্রহণ করেন না, গভীরতায় না গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন না ও বিকল্প পন্থাগুলোও জেনে-বুঝে যাচাই-বাছাই করে বিবেচনা করেন।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের একজন মানুষ অন্য মানুষের কল্যাণ-মঙ্গল চিন্তা করেন, নিজের স্বার্থের চেয়েও পরের স্বার্থের ব্যাপারে এদের বোধবুদ্ধি বেশি টনটনে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে প্রকৃত জ্ঞানে সমৃদ্ধ জ্ঞানীদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, অনেকেরই স্বকীয়তা ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি থাকে, নীচু-হীন মানসিকতা কমে যেতে থাকে, জ্ঞানী-গুণীদের কদর-সম্মান-মর্যাদা থাকে।